লিজেন্ডারি হেমন্ত


লিজেন্ডারি হেমন্ত –
সুনন্দীতা দেবনাথ 
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামটি মনে পড়লেই বাঙালীমাত্রই আমরা এক সুরের জগতে প্রবেশ করি। সেই সাথে কালো ফ্রেমের চশমা ধুতি-শার্টে সর্বভারতীয় বাঙালি ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।এই কিংবদন্তী শিল্পী সম্পর্কে যত লেখা যায় তত শব্দ কম পড়বে।তিনি বাংলা, হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্যে বিভাগে দু-বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন হেমন্ত।
পঞ্চাশ-ষাটের দশককে আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কত বড় গায়ক ছিলেন কিংবা সুরকার সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিটি বাঙালীর কাছে ‘হেমন্ত’ নাম টি যে আবেগ সে কথাও নতুন করে বলতে হয় না। তাঁর গান আজও প্রায় প্রতিটি বাঙালী বাড়িতে বাজে। কালজয়ী এই সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতানুরাগীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। শিল্পীসত্তাকে অক্ষুন্ন রেখে কি করে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায় এমনকি সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা যায়– হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনজুড়ে সেই উদাহরণ স্পষ্ট।
১৯২০ সালের ১৬ জুন, বেনারসের এক প্রখ্যাত চিকিৎসকের বাড়িতে তাঁর কন্যার গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান, নাম হেমন্ত।
তাঁর ছোটবেলা কাটে তিন ভাই আর এক বোনের সাথে।ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন এবং ১৯৬০ এর দশকে কিছু গানও গেয়েছিলেন। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। দেব সাহিত্য কুটিরের এক পূজা বার্ষিকীতে ‘ঠোঙা বাবা’ নামে খুব সুন্দর গল্প লিখেছিলেন তারাজ্যোতি।
সেই শিশু যে কালক্রমে তার স্বর্ণকণ্ঠ দিয়ে ভুবন ভোলাবে, এমন কোনও ইঙ্গিত কিন্তু কেউই পান নি। কলকাতায় বেড়ে ওঠা, প্রথমে নাসিরুদ্দিন স্কুল ও পরে ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে শিক্ষালাভ। সেসময় তাঁর দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর নাম জানেন? কিংবদন্তী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, এবং প্রখ্যাত লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ। শোনা যায়, অদৃষ্টের অদ্ভুত খেয়ালে এই তিন কিশোরের মধ্যে তখন গায়ক হিসেবে পরিচিত ছিল সুভাষ! ওদিকে সন্তোষ কবিতা লিখত, আর হেমন্ত?- সে ছিল ছোটগল্প লেখক।
দ্বাদশ শ্রেণীর পর তৎকালীন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)-এ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন হেমন্ত। সেকথা অনেকেরই হয়তো জানা। তিনি যে তাঁর পিতার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ না করেই সঙ্গীতের প্রবলতর আকর্ষণে উচ্চশিক্ষায় ইতি টানেন, তাও হয়তো জানেন কেউ কেউ। তবে মজাটা হলো, তখনও লেখক হওয়ার বাসনাও একেবারে জলাঞ্জলি দেন নি হেমন্ত। জনপ্রিয় ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি গল্প ছাপিয়েও ফেলেছিলেন, তবে এরপর আর কোনোরকম ‘বিচ্যুতির’ খবর পাওয়া যায় না। মোটামুটি ত্রিশের দশকের শেষ থেকে ১৯৮৯ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকে তাঁর সঙ্গীতের সাধনা।
লেখা না হয় থাক, সুভাষ রয়ে যান তাঁর জীবনে। সুভাষের উৎসাহেই ১৯৩৫ সালে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। গানের প্রথম লাইন ছিল, ‘আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী’। এ সময় হেমন্তের শিক্ষাগুরুর ভূমিকা নিয়েছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত, তবে হেমন্ত নিজের গানের ধাঁচ তৈরি করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম গায়ক পঙ্কজ মল্লিকের অনুকরণে। এতটাই, যে তাঁকে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলে ডাকা হতো! আশির দশকে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হেমন্ত জানিয়েছিলেন যে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ’র কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিমও শুরু করেন তিনি, তবে ফৈয়াজ খাঁ’র অকাল প্রয়াণ সেই শিক্ষায় ইতি টেনে দেয়।
১৯৩৭ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার মালিকানাধীন কলাম্বিয়া লেবেল তাঁকে দিয়ে রেকর্ড করায় শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে দুটি নন-ফিল্ম গান, ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’। তারপর থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত প্রতি বছর গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার জন্য তিনি নন-ফিল্ম গান রেকর্ড করে গেছেন।এটাই তাঁর প্রথম বাংলা গান রেকর্ড।
হেমন্তের প্রথম হিন্দি গান ছিল ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’, সৌজন্যে ফের কলাম্বিয়া, সন ১৯৪০। এই গান দুটির সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত, কথা লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাশমি।
১৯৪১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘নিমাই সন্ন্যাস’-এ হরিপ্রসন্ন দাসের সুরে প্রথমবার বাংলা ছবিতে গান করেন হেমন্ত। হিন্দিতে প্রথম ছবির গান ১৯৪৪ সালে, ‘ইরাদা’ ছবির জন্য, পণ্ডিত অমরনাথের সুরে। সেই একই বছরে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন, তাও ছায়াছবির জন্যই। ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’, গান ‘পথের শেষ কোথায়’।
ফের একবার ১৯৪৪-এই কলাম্বিয়ার সঙ্গে তিনি রেকর্ড করেন তাঁর প্রথম ফিল্ম-বহির্ভূত দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘আমার আর হবে না দেরি’ এবং ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। এর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য তিনি রেকর্ড করেছিলেন ‘আমার মল্লিকাবনে’। দুর্ভাগ্যবশত, সেই রেকর্ডিংটি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।
১৯৪৪ হেমন্তের জীবনে অনেকগুলি মাইলফলক গড়ে দেয়, কারণ সে বছরই বাংলায় প্রথম তিনি নিজের জন্য প্রথম সুর করেন দুটি আধুনিক গানের, ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া’। এরপর স্বাধীনতার বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে প্রথম বাংলা ছবিতে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। তখন পর্যন্ত সমালোচকরা তাঁর গানের প্রশংসা করলেও, সেভাবে জনপ্রিয় হন নি এই কিংবদন্তী। কিন্তু পরবর্তীতে ছবিটা এবার পাল্টাতে শুরু করেছিল।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে হেমন্ত বাংলা সংগীত শিল্পী বেলা মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ  বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন কিন্তু বিবাহের পর বেলা আর সংগীত জগতে প্রবেশ করেননি। তাঁদের দুই সন্তান — পুত্র জয়ন্ত এবং কন্যা রাণু। সীমিত সাফল্য নিয়ে রাণু মুখোপাধ্যায় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের দশকের শেষে এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দশকের শুরুর দিকে গান গাইতেন। জয়ন্ত ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দশকের জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের  সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
চল্লিশের দশকেই ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন বা আইপিটিএ-র সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন যুবক হেমন্ত। আইপিটিএ গড়ে ওঠার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৩ সালের বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তর তথা দুর্ভিক্ষ, যা প্রতিরোধ করার কোনও চেষ্টা করে নি ব্রিটিশ প্রশাসন এবং অর্থবান ভারতীয় সমাজ। আইপিটিএ-তেই হেমন্তের আলাপ হয় আরেক গানপাগল যুবকের সঙ্গে, নাম সলিল চৌধুরী।
সলিলের কথায় ও সুরে ১৯৪৭ সালে হেমন্ত রেকর্ড করেন ‘গাঁয়ের বধূ’। ছ’মিনিটের এই গান ভেঙে দেয় প্রথাগত সঙ্গীতের প্রায় সব নিয়ম। কারণ প্রথমত, গানে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহারের রীতি কোনোদিন ছিল না, বাংলা গানে তো নয়ই। দ্বিতীয়ত, তখন পর্যন্ত বাংলা গান ছিল কাব্যিক, রোম্যান্টিক। সেখানে এক বর্ধিষ্ণু ঘরের পল্লীবধূর দিনলিপি, যা ছারখার করে দেয় দুর্ভিক্ষের দানব, তা নিয়ে যে আদৌ গান হতে পারে, এমনটা কেউ সেই সময় দাঁড়িয়ে কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি।
কিন্তু গানটির অভাবনীয় জনপ্রিয়তা প্রায় রাতারাতি তারকা বানিয়ে দিয়েছিলো সলিল এবং হেমন্তকে, শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারতেই। এবং হেমন্তকে বসিয়ে দেয় তাঁর সমসাময়িক গায়কদের অনেক ওপরের আসনে। পরবর্তীকালে একের পর এক গানে জুটি বাঁধেন দুজনে, এবং তাঁদের জনপ্রিয়তায় কমে আসেনি একটি দিনের জন্যও।
তখন বাংলা গানে নিয়মিত সুর করছেন হেমন্ত, সেসময় পরিচালক হেমেন গুপ্ত তাঁকে ডেকে নিলেন মুম্বইতে, তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি, ফিল্মিস্তান স্টুডিও প্রযোজিত ‘আনন্দমঠ’-এ সুর করতে। সেইমত ১৯৫১ সালে মুম্বই পাড়ি দিলেন হেমন্ত, যোগ দিলেন ফিল্মিস্তানে, পরের বছর মুক্তি পেল ‘আনন্দমঠ’। ‘আনন্দমঠ’-এর গান খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও একটি গান সকলের মনে রয়ে গেল – লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম’।
ফিল্মিস্তানের আরও কিছু ছবিতে সুর দিচ্ছিলেন হেমন্ত, যদিও সেরকম সফল হচ্ছিল না সেসব ছবি। তবে পাশাপাশি যেটা হচ্ছিল, তা হলো হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে ‘হেমন্ত কুমারের’ বাড়তে থাকা চাহিদা, যা জন্ম দেয় কিছু কালজয়ী গানের। শচীন দেববর্মণের সুরে দেব আনন্দের লিপ-এ তিনি গাইলেন ‘জাল’ ছবিতে ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনী ফির কাহাঁ’, ‘হাউজ নং ৪৪’-এ ‘চুপ হ্যায় ধরতি’, ‘সোলভা সাল’ ছবিতে ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’, ‘ফান্টুশ’ ছবিতে ‘তেরি দুনিয়া মে জিনে সে’, এবং ‘বাত এক রাত কি’ ছবিতে ‘না তুম হামে জানো’-র মতো চিরসবুজ গান।
এছাড়াও পঞ্চাশের দশকে প্রদীপ কুমার (‘নাগিন’, ‘ডিটেকটিভ’), সুনীল দত্ত (‘দুনিয়া ঝুকতি হ্যায়’), এবং ষাটের দশকে বিশ্বজিৎ (‘বিস সাল বাদ’, ‘বিন বাদল বরসাত’, ‘কোহরা’) এবং ধর্মেন্দ্রর (‘অনুপমা’) জন্যও প্লেব্যাক করেন তিনি। পাশাপাশি এই সব ছবিতেই সুরও করেন।
তাঁর সুরে ‘নাগিন’ ছবির গান এমনই জনপ্রিয় হয় যে শুধুমাত্র গানের জোরেই বক্স-অফিসে ঝড় তুলে দেয় ছবিটি। এবং এর ফলেই জীবনের প্রথম ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর সম্মানে ভূষিত হন ১৯৫৫ সালে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবনের মাইলফলক নিয়ে লেখা, অথচ উত্তমকুমারের নামগন্ধ নেই তাতে। ঘোর অনাচার। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠিত গায়ক-সুরকারদের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন হেমন্ত। কী ফিল্মের গান, কী রবীন্দ্রসঙ্গীত, তাঁর চাহিদা অব্যাহত। আর কেউ ‘ছোট পঙ্কজ’ বলে ডাকে না তখন, বরং সসম্মানে পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে একাসনে বসানো হয় তাঁকে।
ওদিকে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, এদিকে সেবছরই একটি বাংলা ছবির কাজ শুরু হলো। ছবির নাম ‘শাপমোচন’। ছবিতে অভিনয় করছেন উত্তমকুমার, যিনি তখন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের পায়ের তলার মাটি মজবুত করার চেষ্টায় রয়েছেন। ঠিক হলো, তাঁর প্লেব্যাকে  এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করবেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা।
কিন্তু যাঁর হবার কথা সঙ্গীতশিল্পী, তিনি কি অন্য কোনো কাজে মন বসাতে পারেন! ১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। শেষতক ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদিগো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে গান গাইবার জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে, সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত, হেমন্তকে দিয়ে, ফাইয়াজ হাস্মির কথায়ে “কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে” ও “ও প্রীত নিভানেভালি” গাওয়ালেন। 
চিরসবুজ মনের হেমন্ত –
রানার, পাল্কির গান, বম্বের নাগিন ইত্যাদি গান গেয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন সুপার ডুপার হিট তখন একদিন কলকাতায় গাড়ি করে যাচ্ছিলেন তিনি। চালকের আসনে সবসময়কার মতই সনৎবাবু। হঠাৎ হেমন্ত দেখলেন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ছোট বেলার বন্ধু নন্দন। সনৎবাবুকে বললেন গাড়ি থামাতে। নন্দন দেখলেন হঠাৎ ব্রেক কষে তাঁর পাশে একটা গাড়ি দাঁড়ালো। তিনি একটু সরে দাঁড়ানো মাত্রই গাড়ির জানলা খুলে তাঁকে ডাকলেন ছোটবেলার বন্ধু হেমন্ত, বিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন এস কে নন্দন। এস কে নন্দন তখন অতি সাধারণ চাকরি করতেন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে। কিন্তু মানুষ হেমন্তের কাছে ওসব কোন ধর্তব্যের বিষয়ই ছিল না। বন্ধুর কাছে তিনি কেবল ‘হেমন্ত’ হয়ে ছিলেন, সেলিব্রেটি নয়।
‘কি রে কোথায় যাচ্ছিস?’, বন্ধু হেমন্তের আন্তরিক প্রশ্ন এক মুহূর্তে নন্দনের সমস্ত সংকোচকে উড়িয়ে দিয়েছিল। বন্ধুর গন্তব্য জেনে নিয়ে তাঁকে আর একটি কথাও বাড়াতে দেননি হেমন্ত। প্রায় জোর করেই গাড়িতে তুলে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন।রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ সুর এবং ঘরানাকে গায়কির মধ্য দিয়ে আজীবন তুলে ধরেছেন যে ক’জন শিল্পী তাঁর মধ্যে অন্যতম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
অনেকেই হয়ত জানেন না হেমন্তকুমার তাঁর আত্মকথা লিখেছিলেন যার নাম “আনন্দধারা” ।অনেকেই জানেন, এই সঙ্গীতশিল্পী প্রথম জীবনে হতে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক এবং ‘একটি দিন’ নামে তাঁর একটি গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় পর্যন্ত বেরিয়েছিল। ফলে অনেকদিন পরে লেখা হলেও এই বইটিতেও তিনি প্রাঞ্জল গদ্য উপহার দিয়েছেন। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। এরকম একজন শিল্পীর গড়ে ওঠা ও বহু অজানা তথ্য মিলিয়ে একটি প্রয়োজনীয় ও একই সঙ্গে রসসিক্ত গ্রন্থ হল ‘আনন্দধারা’। বইটি ১৩৮২ (১৯৭৫) সালের ভাদ্র মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নিউ বেঙ্গল প্রেস’।
এক জন গায়ক যিনি সবিনয়ে মৃত্যুর দু’বছর আগে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি নিতে অস্বীকৃত হন, এক জন গায়ক যিনি হলিউডে প্লেব্যাক করেছেন, এক জন গায়ক যাকে বিশ্বভারতী সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে, তিনি জীবন ও মৃত্যুতে ধুতি আর শার্টের মধ্য দিয়ে বাঙালিই রয়ে গেলেন। এমন সুদর্শন, অনুপম কণ্ঠের পুরুষ ছাড়া কে আর আমাদের শাসন করতে পারত স্বাধীনতার পর তিনটি দশক জুড়ে।একদা আমাদের সংস্কৃতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রাজত্ব করতেন বলেই তাঁর শতবর্ষের মুহূর্তে ভগ্ন স্বাস্থ্য, হৃত স্বপ্ন, আমাদের মতো নির্জীব উত্তর প্রজন্মের মনে হয় বাঙালি হয়ে ওঠা কত বড় স্বর্গাভিযান!
তিনি আধুনিক বাংলা গান, চলচ্চিত্রের গান যেমন গেয়েছেন-তেমনই আজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও গেঁথে রয়েছে বাঙালির মনে। বেশ কিছু ছবিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি। জানা যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথমবার রবি ঠাকুরের গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪২ সালে অপরাধ ছবির জন্য। গানটি ছিল-ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত,‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি। ১৯৪৪  সালে মুক্তি পায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক রেকর্ডের রবীন্দ্রসঙ্গীত।গান দুটি ছিল- ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ও ‘আমার আর হবে না দেরি’।হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রায় দেড়শোটি বাংলা ছবিতে সুর দিয়েছেন, গান গেয়েছেন। তাঁর প্রয়াণের প্রায় দুই দশক পরেও গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া প্রত্যেক বছর অন্তত একটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অ্যালবাম প্রকাশ করে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে সঙ্গীতে জগতে অবদান রাখার জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে ভূষিত করে, তিনি এই পদক প্রত্যাখান করেন। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসে এই গানটি শুনিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর বয়সের ছাপ পড়া গলাতেও তিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে লালন ফকির চলচ্চিত্রে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়কের সম্মান পেয়েছিলেন।
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাইকেল মধসূদন পুরস্কার  গ্রহণের জন্যে তথা একটা কনসার্টে সংগীত পরিবেশনের তাগিদে হেমন্ত বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ভ্রমণ করেছিলেন। ওই সফরের অব্যবহিত পর ফিরেই ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি আর একটা হৃদাঘাত পেয়েছিলেন এবং দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিং হোমে রাত ১১:১৫টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে এই শিল্পীর স্বরলিপি চিরদিনের জন্য খোদাই করা হয়ে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপমহাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আজ মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এই শিল্পীর স্বরলিপি ও সংগীত জগতে  তাঁর অবদান  চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্য সূত্র সম্পাদনা-

হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়, ‘আনন্দ ধারা’, দেব সাহিত্য কুটীর প্রেস, কলকাতা, ১৯৭০।

এ. রাজাধ্যক্ষ এবং পি. উইলহেল্ম, ‘অ্যান এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’, দ্বিতীয় সংস্করণ, ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট, ১৯৯৯।

এস. ভট্টাচার্য, ‘আমার গানের স্বরলিপি’, এ. মুখার্জি প্রেস, কলকাতা, ১৯৮৮।

“শতবর্ষ ছুঁলেন আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ”। ইরাবতী। ১৬ জুন ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০২০।

“Hemanta Mukhopadhyay had left his engineering studies for music! – Times of India”। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০২০।

Tagore Songs by Hemanta Mukherjee. faculty.ist.unomaha.edu

Debashis Dasgupta, Desh, Bengali weekly magazine from Anandabazar Patrika Ltd., Calcutta, 11 November 1989. P. 36

S. Bhattacharya, Amar gaaner swaralipi, A. Mukherjee Press, Calcutta, 1988. Pp. 82,83,84

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights