গোষ্ঠ পাল: মোহনবেঙ্গলের ‘চাইনিজ ওয়াল’


গোষ্ঠ পাল:মোহনবেঙ্গলের ‘চাইনিজ ওয়াল’

মানস শেঠ

   

১৮৯৬ এর ২০ শে আগস্ট ফরিদপুর জেলার ভোজেশ্বর গ্রামের আকাশ সেদিন ছিল উজ্জ্বল,ঝলমলে।মাদারিপুর সাব-ডিভিশন।প্রসব যন্ত্রনায় কষ্ট পাচ্ছেন সেই গ্রামের শ্যামলাল পালের স্ত্রী।শ্যামলাল তখন কলকাতায় ব্যবসার কাজে ব্যস্ত।তিনি ছিলেন বরিশালের ঝালকাটি বন্দরে তেজারতির ব্যবসায়ী।খবর পেলেন পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন তিনি।বাবা যখন হয়েছেন,তখন কি আর খালি হাতে ছেলের মুখ দেখবেন?কলকাতায় এসে টুকিটাকি জিনিস কেনার সময় একটা সোনার বিছেও কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন।সেটা নিয়ে উনি গেলেন কর্মক্ষেত্র বরিশাল,এতটাই অসুস্থ হয়ে গেলেন যে আর ভোজেশ্বর গ্রামে ফিরতে পারলেন না।কলকাতাতেই অসুস্থ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।জনকের সন্তানটি তখন মাস দেড়েক,নামকরণ হলো-গোষ্ঠ পাল।

বিধবা শ্যামলালের স্ত্রী ওইটুকু ছেলেকে নিয়ে চলে এলেন বাপের বাড়ি।মা-দিদিমার আদরে বড়ো হতে লাগল ছোট্ট গোষ্ঠ।বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেই গোষ্ঠ পাল বলতেন,”বাবারে আমি দেখি নাই।তার সম্পর্কে কি কমু?আমার মায়-ই সব।মা আমারে বড় করসে।”অথচ যখন গোষ্ঠ পাল তাঁর আত্মজীবনী লিখছেন,তখন প্রথমেই ছিল বাবা শ্যামলালের কথা।পিতাহারা সন্তান বয়সের সাথে সাথে দুস্টুমিতে হয়ে উঠেছিলেন তুখোড়।একটা গল্প বলি,গোষ্ঠর মা বঁটিতে বসে ডাঁটা কাটছেন,কিছু একটা দরকার উঠে গেছেন সেইসময় মায়ের জায়গায় এসে বসলেন গোষ্ঠ।শুধু তাই না,ডাঁটা কাটতে শুরু করেও দিলেন।হঠাৎ ডাঁটার বেমক্কা চাপে বঁটির ডগা ছিটকে উঠে সোজা ধারাল দিকটি বিঁধে গেল গোষ্ঠর ডান কাঁধে।গোষ্ঠ নীরব,চোখ দিয়ে জলও পরছে না।মনে একরাশ কষ্ট-ডাঁটা কাঁটা পরে থাকল অসমাপ্ত।মা এসে এই রক্ত দেখে হইচই ফেলে দিলেন,এলেন ডাক্তার।বাঁধা হলো পটি।সবাই অবাক হয়ে ভাবছিল,এইটুকু ছেলের এতটা সহ্যশক্তি!কেউ কেউ বলল,এ ছেলে ডাকাত হবে।যদিও,পরে গোষ্ঠ ডাকাত হয়েছিল সেটা একটু পরে আসছি।

গোষ্ঠ পাল এলেন কলকাতা,পড়াশোনায় তিনি যে খুব তুখোড় ছিলেন,এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।কলকাতায় ছোটমামা আর বাড়ির পরিচারক ছিলেন তার বন্ধু।এখানে তিনি পেলেন সরোজ রায় কে।দু’জনের খুব ইচ্ছে ফুটবল খেলার।স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বড় ফুটবলার হবার।শ্যমলালের জ্যাঠতুতো ভাই মতিলালবাবু একদিন একটা বল কিনে এনে দিলেন।সেই বলকে ঘিরেই একদল বন্ধু জুটল,গড়ে উঠল একটা ক্লাব।নাম দিল-‘দি ক্যালকাটা ইউনিয়ন ক্লাব’,গোষ্ঠ পাল তখন কলকাতার কুমোরটুলিতে।সেখানে ছিল একটি ফুটবল সংস্থা ‘কুমারটুলি জুভেনাইল্’,সেখানে ফুটবল খেলতে সুযোগ পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।গোষ্ঠ পাল যোগ দিলেন সেই ক্লাবে।

ফুটবলের কথা যখন বলতে বসেছি,এর সাথে দেশের কথা না বললে বেশ কিছুটা বাকি থেকে যায়।ভোজেশ্বর গ্রামের ছেলেটি যখন কলকাতায় পা রাখছেন তখন কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষ।গ্রেগরীয় পঞ্জিকা মতে ১৮০১-১৯০০ সাল পর্যন্ত কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী।এই শতাব্দীতে স্পেন,পর্তুগিজ আর ওসমান সাম্রাজ্যের পতন হয়,রোমান ও মোগল সাম্রাজ্যও দেখে পতনের মুখ।নেপোলিয়নীয় যুদ্ধগুলো শেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের নেতৃত্বে আর্বিভূত হয়।বিশ্বের এক চতুর্থ অংশ জনগণ এবং এক তৃতীয়াংশ ভুখন্ড এই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।ভারতবর্ষ ছিল এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনেই।পুরো ভারতবর্ষের মানুষ ব্যতিব্যস্ত ছিল এই ব্রিটিশ শাসন বা অত্যাচার সহ্য করার আর গুটিকয়েক আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টায়।ফুটবল কিন্তু তার থেকে আলাদা ছিল না।শক্তিমান সাহেব দলগুলোর সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করাই ছিল এই দেশের ক্লাবগুলোর প্রধান লক্ষ।ক্যালকাটা ক্লাব,নর্থ স্ট্যাফোর্ড,লিস্টার্স,হাইল্যান্ড ইনফ্যান্টি-প্রায় সবার বিপক্ষে যে তীব্র লড়াই গড়ে তুলেছিল,সে হলো মোহনবাগান।এই লড়াইয়ের পুরোভাগে ছিলেন গোষ্ঠ পাল।

১৯০৫ এ ভারতে ঘটেছে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন।গোষ্ঠ পাল ও কিছুটা জড়িত এই আন্দোলনের সঙ্গে।এরপর রবি ঠাকুরের নোবেল প্রাইজ পাবার মাত্র দুই বছর আগে আরেকটা বিশাল কান্ড ঘটে গিয়েছিল সেটা হল ১৯১১ সালে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে মোহনবাগান জয় করল আই.এফ.এ শিল্ড।এই সংবাদ আরও প্রচার হয়েছিল,কারণ প্রতিপক্ষ ছিল সাহেবদের দল।

যে দল জিতল,সেই দল কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ তারপর থাকল না।ভাগ্যকুলের রায়মশাই রা খুব চেষ্টা করেও মোহনবাগানের পুরো দলটাকে নিয়ে যেতে পারলেন না।তবে দুই ফুটবলার রাজেন সেন আর অভিলাষ তাঁদের টুর্নামেন্টে খেলতে গেলেন স্থানীয় একটি ক্লাবের হয়ে।এই খেলায় ‘হোস্ট টিম্ ‘ভাগ্যকুল ক্লাবের হয়ে খেলতে নামলেন বছর ষোলোর গোষ্ঠ পাল।গোষ্ঠ পালের খেলার ধরণ ভালো লেগে গেল রাজেন সেনের।তিনি গোষ্ঠ পালকে অফার দিলেন মোহনবাগানের হয়ে খেলার এবং নিজে ফিরে এলেন কলকাতা।শিল্ড জয়ের পরের বছর সুধীর চ্যাটার্জি অবসর নিলেন মোহনবাগান থেকে, সেই জায়গায় সুযোগ পেলেন গোষ্ঠ পাল।মঞ্জুর করলেন ক্লাবের সর্বময় কর্তা শৈলেন বসু,মেজাজ ছিল তাঁর মিলিটারি।

মোহনবাগানে পা দিয়েই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হল গোষ্ঠ পালকে।আসাদুল্লা কাপ।মোহনবাগান বনাম কাস্টমস্।সেই ম্যাচে মালকোচা মারা ধুতি পরে নামলেন গোষ্ঠ পাল।বৃষ্টি পড়ছে তুমুল।মাঠ ভেজা,সুবিধা করতে পারলেন না গোষ্ঠ পাল।দর্শকরা বললেন,’র মেটিরিয়াল, মোহনবাগানে চলবে না’।কথাগুলো হজম করলেন তিনি,খুঁজছিলেন জবাব তিনি ফিরিয়ে দেবেনই।অপেক্ষা করতে হবে পরের ম্যাচের জন্য।পরের ম্যাচ মোহনবাগান বনাম ব্ল্যাক্ ওয়াচ্।ব্ল্যাক ওয়াচের বিরুদ্ধে খেলায় খালি পায়ে বুট পরা ইংরেজদের নাচিয়ে ছেড়ে দিলেন লেফট্ ব্যাক ভূতি-সুকুলের সঙ্গে।তারা ত গোল দিতে পারলেনই না,একেবারে লজ্জায় তারা অবনত।সাল তখন ১৯১৩।এই খেলার পর থেকেই পাকাপাকি ভাবে গোষ্ঠ পাল জায়গা পেলেন মোহনবাগানে,সাল ১৯১৩ এবং গোষ্ঠ পাল তখন মাত্র ১৭।গোষ্ঠ পালের আইডল ছিলেন শিবদাস ভাদুড়ি এবং স্যার দুখিরাম মজুমদার।যদিও ইনি ছিলেন এরিয়ানের প্রাণপুরুষ।

মোহনবাগান যদি খেলতে নামতেন ৫-৩-২ ছকে, তবে গোষ্ঠ পাল ছিল তাঁর সেরা ব্যাক।লম্বা টানা কিক,নির্ভয় ট্যাকলিং,প্রতিপক্ষকে হিমশীতল মেজাজে তারা করা আর গোটা মাঠে বুদ্ধিদীপ্ত খেলা খেলে গোষ্ঠ পাল হয়ে উঠল অনবদ্য এবং অনুপম।”দ্য ইংলিশ ম্যান”এর এক দুঁদে সাংবাদিক রেড রোজ ছদ্মনামে লিখেই দিলেন,

“Gostha Imapegnable as the Chinese Wall”

বাঙালির ইতিহাসে লেখা হলো”গোষ্ঠ পাল-দ্য চাইনিজ ওয়াল”।একটা পরাধীন জাতির আশা-আকাঙ্খা,অবদমিত পিপাসা সবকিছু তখন মোহনবাগানের মাঠ থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করছে, মোহনবাগান তখন আর শুধু কলকাতার নয় সে হয়ে উঠেছে সমগ্র ভারতবর্ষের একটা পরিচয়।সেই ভারতবর্ষের গড়ের মাঠে একা লড়াই করে চলেছেন,একটা নগ্নপদ মালকোঁচা মারা বাঙালি-গোষ্ঠ পাল।গোষ্ঠ পালের পা দুটো ছিল থামের মতো।ষন্ডামার্কা ইংরেজ পল্টনরা ভয় পেত ওর কাছে ঘেঁষতে,তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-“গোরাদের পায়ে ভারী বুট,আপনার ভয় করে না?”গোষ্ঠ পাল মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন,-“ভয়?আমারেই ত ওরা ভয় পাইল চিরডা কাল,আমি আবার ভয় করলাম কারে?এরই নাম আত্মবিশ্বাস,অহংকার নয়।”

মোহনবাগান এ তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৩ সালে,টানা ২৩ বছর খেলার পর তিনি অবসর নেন।ততদিনে খেলোয়াড় গোষ্ঠ পাল থেকে,কিংবদন্তি গোষ্ঠ পাল।স্যার দুখিরাম মজুমদার লিখলেন,”যেন মত্ত সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছেন”কোথাও লেখা হলো”বাঘের মত বিক্রম,সাপের মত তীব্র চেতনা,চিতার মত ক্ষিপ্র গতি,চীনের প্রাচীরের মত দুর্ভেদ্য।”তার ছিল সেইরকম চলন,সেই রকম রাজকীয় পদক্ষেপ।কে যে কবে তার পাস দিয়ে ড্রিবল করে যাবার সাহস দেখিয়েছিল,সেকথা অণুবীক্ষণ দিয়ে খুঁজতে হবে।উল্টে গোষ্ঠ পালের পায়ে বল দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এলসন্,পপল্,গামারি, নাইট্,হ্যারিসন্,গ্রিডস্,স্টিলের মত দুর্ধর্ষ ফুটবলাররা।গোষ্ঠ পাল সামনে থাকায় গোলকিপার অনু ভট্টাচার্যরা ছিলেন নিশ্চিন্ত।উনি কি খেতেন,সেটা জিজ্ঞাসা করলে মজা করে বলতেন ‘যা পাই তাই খাই’।পাকস্থলীতে গেলেই হজম হয়ে রক্তে মিশে গিয়ে সেই খাদ্যের নাম হয়ে যেত দম,স্ফূর্তি এবং আত্মনির্ভরতা।

মোহনবাগান নিয়ে এত কথা বলার পরও এটা বলতে হবে গোষ্ঠ পাল শুধু মোহনবাগানের না,উনি ইস্টবেঙ্গলেরও।মোহনবাগানের সমর্থকরা একটু কিন্তু কিন্তু করলেও,ইতিহাস ত কখনো বদলে যায় না।জানি,গোষ্ঠ পালের একচেটিয়া অধিকার মোহনবাগান দখল করলেও,ইস্টবেঙ্গল কিন্তু সেরকম পিছিয়ে নেই।২০২০ হলো,ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ।একটু এক’শ বছর পিছনের পথে হেঁটে দেখি, কি করে গোষ্ঠ পাল হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গলের।

১৯১১ সালে মোহনবাগান যখন শিল্ড জিতল তখন সেই দলে খেলত আটজন পূর্ববঙ্গের খেলোয়াড়।পদ্মার ওপার থেকে আসা মানুষজনদের এপারের লোকরা বলত বাঙাল।অপমানিত বোধ করলেও তারা কিছু বলতে পারত না।শিল্ড জেতার পর কিছুটা জবাব দিলেও,সেটা সম্পূর্ণ ছিল না।এর মাঝে ১৯১৫ সালে পূর্ববঙ্গের ঢাকা উয়াড়ি কলকাতায় প্রথম শিল্ড খেলতে আসে,১৯১৮ তে মোহনবাগানকে হারিয়ে দেন।কলকাতায় বাস করা পূর্ববঙ্গের মানুষরা খুঁজছিল প্রতিবাদের ভাষা,পেয়েও গেল যেন খানিকটা।এই সময় পূর্ববঙ্গের মালখান নগরের বিখ্যাত বসু পরিবারের ছেলে শৈলেশ বসু গেমস টিচারের চাকরি করতেন কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজে আর ফুটবল খেলতেন স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবে।কর্তৃপক্ষর সাথে মতবিরোধের জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং যোগাযোগ করেন সুরেশ চৌধুরীর সাথে।এই সুরেশ চৌধুরী ছিলেন জোড়াবাগান ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট।তিনি শৈলেশ বসুকে বলেন তিনি তাকে চাকরি দিতে পারেন এই শর্তে যে,শৈলেশ বসুকে খেলতে হবে জোড়াবাগানের হয়ে।

১৯২০ সালের কোচবিহার কাপ।সেমিফাইনাল খেলা।জোড়াবাগানের সাথে ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের খেলা।সেই ম্যাচে শৈলেশ বসু আর নসা সেনকে অন্যায়ভাবে বাদ দিল ক্লাব-কর্তারা।বাদ দেবার কারণ,ওরা দুজন ছিল পূর্ববঙ্গের মানুষ।অসন্তুষ্ট হলেন সুরেশ চৌধুরীও।জোড়াবাগান ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন এবং এপার বাংলার মানুষদের শিক্ষা দেবার জন্য খুললেন নতুন ক্লাব।শৈলেশ বসু তখন নাম দিলেন ‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব’,এই ক্লাবের নাম শুনে সুরেশ চৌধুরী আপত্তি করলেন,কারণ তিনি ভাবলেন এতে প্রাদেশিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।পরে অবশ্য রাজি হন তিনি।

১লা আগস্ট ১৯২০ তে বিকেল চারটের সময় সুরেশ চৌধুরীর জোড়াবাগানের বাড়িতে একটা সভা ডাকা হয়।সেখানে উপস্থিত ছিলেন শৈলেশ বসু, ডক্টর রমেশ চন্দ্র সেন,সুরেশ চৌধুরী।সর্বজনভাবে গৃহীত হলো,ক্লাবের নাম হবে ইস্টবেঙ্গল।এরপর শুরু হলো প্লেয়ার জোগাড়ের পর্ব।

তিন চার দিন পরেই আই.এফ.এর অনুমোদন সুরেশ চৌধুরী করিয়ে দেন।ওনার বন্ধু তৎকালীন আই.এফ.এ সচিব মেডিলিকটকে নিয়ে।এরপর দরকার খেলার জার্সি,তখন ইংল্যান্ড থেকে কুড়ি-পঁচিশ টাকা দিয়ে ঝলমলে জার্সি আসত।সুরেশ চৌধুরী তখন অরবিন্দ ঘোষকে নিয়ে এসপ্ল্যানেডের বিভিন্ন দোকান চষে ফেললেন।শেষে গেলেন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হোয়াটিওয়াট লাইডলাও অ্যান্ড কোম্পানিতে।দোকানে তাদের চোখে পড়ল বিজ্ঞাপনের জন্য প্রদর্শিত হওয়া লাল-অম্বর রঙের বিরাট এক জার্সির জন্য।দাম আশি টাকা।কিনে আনলেন সেদিনই।ওই লাল-অম্বর রঙের জার্সি পরেই খেলতে নামল ইস্টবেঙ্গল।কাপ-হারকুইলিস।

হারকুইলিস কাপ হলো এমন একটা কাপ তখন কলকাতার শ্যাম পার্ক অঞ্চলে ৬ এ সাইড একটি ফুটবল প্রতিযোগিতা হত।প্রথমে ৫ জন প্লেয়ার যোগ হল।শৈলেশ বসু আর ডক্টর রমেশ চন্দ্র সেন ত ছিলেনই এর সাথে যোগ দেন গোলকিপার হিসেবে নগেন কালি,চারু বসু এবং ভোলা সেন।শেষে ডিফেন্ডার হিসেবে আসেন গোষ্ঠ পাল।গোষ্ঠ পাল,ওপার বাংলার বলেই সবার সাথে পরিচয় ছিল ভালোই।তাই বন্ধুরা যখন ক্লাব করে খেলতে ডাকেন তখন তিনি না করতে পারেনি।গোষ্ঠ পাল ও জানতেন না,এই ক্লাবটাই পরে এক বিশাল মহীরুহ আকার ধারণ করবে।যাই হোক, শেষে ইস্টবেঙ্গল তাদের দুটি টিম তৈরি করেন,প্রথম টিমে ছিল গোষ্ঠ পাল,নসা সেন,শৈলেশ বসু,চারু বোস এঁরা।১৯২০ এর ১১ ই আগস্ট শ্যাম পার্কে হারকুইলিস কাপের প্রথম খেলায় গোষ্ঠ পালের অধিনায়কত্বে টিম ‘এ’ ক্লাব ৪-০ গোলে হারায় মেট্রোপলিটন কলেজকে।তারপরের খেলাও যেতে।সেমি ফাইনাল ইস্টবেঙ্গলের টিম ‘এ’ ও টিম ‘বি’।টিম ‘বি’ নাম তুলে নেওয়ার ফলে ইস্টবেঙ্গল টিম ফাইনাল খেলে ডি.সি.এল.আই এর সাথে,এবং এক গোলে হারিয়ে হারকুইলিস কাপ জিতে নেয় ইস্টবেঙ্গল।বিজয়ীদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় সোনার মেডেল।কিন্তু, ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ট্রফি-জয়ের যে খবর বেরিয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকায়, কোনো এক আশ্চর্য কারণে সেখানে নাম ছিল না গোষ্ঠ পালের। পরের বছর ফের মোহনবাগানে ফিরে গেলেন তিনি। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের সম্পর্ক বড়োই সংক্ষিপ্ত, অথচ ঐতিহাসিক।

তখনো ইস্টবেঙ্গল বড়ো ক্লাব হয়নি। মোহনবাগান ক্লাবের নাম ও মর্যাদা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকে বলেন, হারকুইলিস কাপের জন্যই নাকি গোষ্ঠ পালকে মোহনবাগান থেকে ধার করে এনেছিলেন সুরেশবাবু। হয়তো তাই সত্যি। নাহলে,এটাই হয়তো হত এই দুই ক্লাবের ভিতরে প্রথম ‘হাই-ভোল্টেজ’ দলবদল।ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতোই গোষ্ঠপালের সেই ‘দলবদল’-ও কিন্তু একশো বছরে পা দিল।

মোহনবাগান মানেই দেশ,মোহনবাগান মানেই জাতীয়তাবোধ,স্বাধীনতা।কিন্তু মোহনবাগান মানে ঘটি,হতেই হবে এপার বাংলার মানুষ-এরকম কোন মানে নেই।মাঠের ভিতর ত ছিলই না।শুধু গোষ্ঠ পাল না,পরবর্তীকালে চুনী গোস্বামী,সুব্রত ভট্টাচার্য এরা সবাই ছিলেন পদ্মাপাড়ের মানুষ, কিন্তু মানুষ তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন।আবার একথাও মানতে হয়,মোহনবাগান প্রথম লিগ যেতে ১৯৩৯,দলটার জন্ম ১৮৮৯ তে।মোহনবাগান ১৯১১ সালে আই.এফ.এ জিতে,সেই ঘৃতসুগন্ধী এখনও এই দলটার গর্বের কারণ।কলকাতা লিগ ইস্টবেঙ্গল পায় ১৯৪২ এ।মোহনবাগান ১৯৪৩ এ।ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের প্রথম লীগ ম্যাচ হয় ১৯২৫ এ।ইস্টবেঙ্গল যেতে ১-০ তে।গোল দেন এন.চক্রবর্তী।স্বাধীনতার আগেই বাঙালি দর্শকদের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করে গিয়েছেন ব্রিটিশরা।মাঠে ইস্টবেঙ্গলের আত্মপ্রকাশ মোহনবাগানের লীগ খেলতে শুরু করার নয় বছর পর।কিন্তু তখনও দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হয়নি।দু দলের সমর্থকদের একটাই লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের নাস্তানাবুদ করা।ইস্টবেঙ্গলের তখন নিজস্ব মাঠ-তাঁবু ছিল না।সেই সময়কার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার  চার্লস টেগার্ট একটা চাল চাললেন।মোহনবাগান মাঠে ঢুকিয়ে দিলেন ইস্টবেঙ্গলকে।এক মাঠ,গ্যালারিতে পাশাপাশি বসার জায়গা,পাশাপাশি তাঁবু।জয়-পরাজয়ে একে অপরকে টিটকারি,টিপ্পনি,খুনসুটির তখন থেকেই শুরু।এর বাইরে কোনও দলের সমর্থকরা কিছু ভাবতে পারতেন না।কিন্তু ত সেটা বীজ,যা পুঁতেছিলেন টেগার্ট।ধীরে ধীরে সেটাই মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়।ঘটি বাঙালে ভাগ হয়ে গেল বাঙালি।

আবার ফিরে আসি গোষ্ঠ পালের কথায়।ওই একটিবারই সে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছিল।তিনি মোহনবাগানেরই ছিলেন।১৯২৯ সালে ডুরান্ড কাপের একটি ম্যাচ।কোয়ার্টার ফাইনাল স্যান্ডেমোনিয়াম মুসা একবার চরম ফাউল করে গোষ্ঠ পালকে এমন চোট মারেন যে,গোষ্ঠ পাল মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য হন।তবে,সেই অপমান খুব সহজে মেনে নেয়নি তুলসী দাস।তিনি সারে ছয় ফুট লম্বা মুসাকে মাটিতে ফেলে তাঁর বুকে চেপে বসে চিৎকার করে বলেছিলেন,”তুমনে গোষ্ঠ পাল কো মারা,ম্যায়নে উসি কা বদলা নিয়া”।এটাও আমাদের মানতে হয়,মোহনবাগান কিন্তু গোষ্ঠ পালের সময় কোনো নামী টুর্নামেন্টে জয়ী হতে পারেনি।ডুরান্ড বা ডোভার্স কোনটাতেই না।গোষ্ঠ পাল এতে বলেছিল,

“ট্রফি পাওয়ার কথা যত না চিন্তা করসি,সাহেব গো হারামু কি কইরা সেই চিন্তাই তখন বেশী করসি।ট্রফি পাই নাই বইল্যা আমাগো কষ্ট হয় নাই।”

গোষ্ঠ পাল কিন্তু ছিলেন আদ্যন্ত বাঙালি খেলার মাঠে পোষাক বলতে মালকোঁচা মারা ধুতি।শুধু ফুটবলে নয়,ক্রিকেট খেলার সময় একই পোশাক।তিনি বাংলার ক্রিকেটের জনক অধ্যক্ষ সারদা রঞ্জন রায়ের সান্নিধ্যে এসেছিলেন।সাহেবরা খেলতে নেমে বলতেন,-“ধুতি নট্ এলাউড্।”গোষ্ঠ পাল মানলেন না।খেলা বানচাল হয়ে গেল।পরে অবশ্য ক্যালকাটা ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিরা ‘সরি’বলেন”লেট্ আস্ ফরগেট্ দ্যাট্ ইনসিডেন্ট্”।গোষ্ঠ পাল খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে।খেলার সময় বুট পরা ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের তিনি খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করেন।পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান রক্ষণে তার বিক্রমকে ভয় পেত বুটপরা ইংরেজ ফুটবলাররাও।ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রি. তিনি সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় যান।পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের অধিনায়ক নির্বাচিত হন।যেতে পারেননি অবশ্য আঘাতের কারণে।ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়ক হন ১৯২৪ এ।তিনি হকি খেলাতেও দক্ষ ছিলেন এবং টেনিস খেলতেন।গোষ্ঠ পালকে নিয়ে কলকাতা ময়দানে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। একটি ম্যাচে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ভুল পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন রেফারি। প্রতিবাদে মাঠের ভিতরে শুয়ে পড়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। তাঁর দেখাদেখি বাকিরাও মাঠে শুয়ে রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। গোষ্ঠ পালের এহেন প্রতিবাদে খুশি হয়নি আই.এফ.এ। তাঁকে সাসপেন্ড করতে চেয়েছিল ফুটবল সংস্থা। সেই খবর গোষ্ঠ পালের কানে পৌঁছতেই তিনি ফুটবল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। 

প্রথম দিকে যেটা বলছিলাম ছোটবেলায় যখন গোষ্ঠ পালকে শুনতে হয়েছিল এ ছেলে বড় হয়ে ডাকাত হবে,এবং সত্যি পরবর্তী কালে তিনি নকল ডাকাত হয়েছিলেন সিনেমায়।১৯৩২ সাল,নির্বাক যুগের শেষ।ন্যাশনাল্ পিকচার্স লিমিটেড্ নামে নতুন চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।তাঁরা একটি নতুন ছবি উপহার দিলেন “গৌরিশঙ্কর”।পরিচালক ছিলেন আনন্দমোহন রায় বা এন্ডিমুর রায়।এতে ভোলা সর্দার এর ভূমিকায় অভিনয় করলেন গোষ্ঠ পাল।ভোলা ছিল ডাকাতের সর্দার।এই সিনেমার অভিনয় দেখেছিলেন আরবি-রাখাল ভট্টাচার্য স্বয়ং।সেই ডাকাত গোষ্ঠ ছিলেন স্বদেশী ডাকাত-তাই পায়ে চেন বাধা থাকলেও পরনে ছিল বিপ্লবীর পোশাক-খদ্দর।

১৯৭৬ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে৷ তবে ১৯৬২ সালে গোষ্ঠ পালকে ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন ।ফুটবলার হিসেবে তিনিই প্রথম পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন । মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মরনোত্তর মোহনবাগান রত্ন দিয়েছে । ইডেন গাডেন্স ও মোহনবাগান মাঠের সামনে দিয়ে যাওয়া কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটিই গোষ্ঠ পাল সরণি এবং ওই রাস্তায় তাঁর একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে । মোহনবাগান ক্লাবের ভিতরে রয়েছে তাঁর নামাঙ্কিত একটি সংগ্রহশালা- গোষ্ঠ পাল সংগ্রহশালা। সেন্ট্রাল কলকাতায় রয়েছে গোষ্ঠ পাল মেমোরিয়াল স্পোর্টিং ক্লাব ও চালু হয়েছে গোষ্ঠ পাল চ‍্যাম্পিয়ান্স বেবি লিগ।তাঁর উপর ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে।গোষ্ঠ পাল এক সভায় বলেছিলেন,

“মোহনবাগানের জার্সির জন্যেই লোকে আমাকে চেনে,এই জার্সিই আমাকে খেলা শিখিয়েছে,এটা আমার প্রিয়,আমি একে আমার মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি,আমি ছেলেকে বলেছি আমার মৃত্যুর পরে যেন আমার চিতায় এই সবুজ-মেরুন জার্সিটা বিছিয়ে দেয়,এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”

 গোষ্ঠ পালের এত সম্মান এত কিংবদন্তী সবটাই ঠিক থাকলেও,কোথাও যেন একটু ধুলো পরে যায়,তাই সংবাদ মাধ্যমের সামনে গোষ্ঠ পালের পুত্র 

নীরাংশু পালকে বলতে হয়, 

‘‘বাবা চলে গিয়েছেন ১৯৭৬ সালে। ১৯৯২ সালে বাবার ইচ্ছানুয়ায়ী সমস্ত পুরস্কার, ট্রফি, দিয়ে এসেছিলাম মোহনবাগানের হাতে। আসলে বাবা চাইতেন, প্রাক্তন ফুটবলারদের পাওয়া পুরস্কারগুলো ক্লাবের প্রদর্শনশালায় জায়গা পাক। সেগুলো দেখতেই সমর্থকরা আসবেন। তাতে অর্থাগম হবে ক্লাবেরই। বিশ্বের সমস্ত ক্লাবেই রয়েছে এমন ব্যবস্থা। কিন্তু সেই সব ট্রফিগুলো এখন কোথায় রয়েছে, তার সন্ধান আমার জানা নেই। মনোকষ্টেও ভুগছি।’’ 

বর্তমান সময়ের অভিমুখ বড্ড সিলেবাসমুখী,দ্বাদশ শ্রেণীর ভাষার ইতিহাসে মাত্র কয়েকলাইন আছে এই মানুষটির সম্পর্কে।এর বাইরে জানার আগ্রহও তাদের নেই।আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কি মনে হচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছেন কিংবদন্তি ফুটবলার? মোহনবাগানের শিল্ড জয় নিয়ে সিনেমা হয়েছে”এগারো”। কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিমকে নিয়ে ছবি তৈরি হতে চলেছে।কোচের ভূমিকায় অজয় দেবগন।ছবিটির প্রযোজনার দায়িত্বে জি স্টুডিও,বনি কাপুর, আকাশ চাওয়াল এবং জয় সেনগুপ্ত।শিবদাস ভাদু়ড়ির ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ভাবছেন জন আব্রাহাম।আর,গোষ্ঠ পালকে নিয়ে রূপোলি পর্দায় নামানোর কথা ভাবছেন না কেউ? অথচ তাঁর জীবনে তো রয়েছে অনেক গল্প। রয়েছে সিনেমা হওয়ার রসদ।নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বায়োপিক তৈরি করছেন,ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়,নাম ‘গোলন্দাজ’তবুও গোষ্ঠ পালকে নিয়ে হচ্ছে না বায়োপিক।যদি কোনো বলিউড-টলিউড ভাবতে বসেন,গোষ্ঠ পালকে নিয়ে হোক বায়োপিক্,তবে বোধহয় সেই ফেলে আসা  স্মৃতি আবার হয়ত জেগে উঠবে বাঙালির মননে।অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি-বা আছে আমাদের?

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights