ইতিহাসের পুজো,পুজোর ইতিহাস


ইতিহাসের পুজো,পুজোর ইতিহাস –
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক 
ইঁট,কাঠ,পাথরের রুক্ষ শহরে বহুতলের দাপটে যতই সবুজ হারিয়ে যাক, কাশফুল আর শিশিরের অদর্শন যতই বাড়ুক, তবু নিয়ম মেনে শরৎ আসে| আর শরৎ আসা মানেই পুজোয় ঢাকের কাঠি| আকাশে বাতাসে কেমন যেন পুজোর সুঘ্রাণ| যদিও এ বছর পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে এক গহীন আঁধার| মারণ রোগের দাপটে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গোটা বিশ্ব| কোভিড নাইন্টিন, মহামারী, লকডাউন, মারণব্যাধি, মৃত্যু মিছিল সহ নানা নতুন নতুন শব্দবন্ধের সংক্রমণ ভুবন জুড়ে|অকস্মাৎই পৃথিবীর এই রূপ| তবুও এত কিছুর পরেও এই ক্রান্তিকালেও প্রকৃতি কিন্তু পৃথিবীর বুকটিকে সাজিয়ে দিচ্ছে তার রং আর রূপের পশরা দিয়ে| নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা,ঝিরঝির বৃষ্টি আর শিউলি নিয়ে মায়াময় শরৎ আসে| আর শরৎ আসা মানেই জগজ্জননীর আগমনবার্তা এবং অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু| তাই বোধহয় বাংলা ও বাঙালির জীবনে শরৎ ঋতুর প্রভাব বড্ড বেশি|
এবছর করোনা আবহে দুর্গাপুজোর আড়ম্বর কিছুটা কম হলেও যথাবিহিত নিয়ম মেনে আনন্দময়ীর আরাধনা হবেই| সুরক্ষা বিধি রক্ষা করে উঠবে চাঁদা,হবে ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন, সপ্তমীতে অধিবাস,অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো আর নবমীর যাগ যজ্ঞ|
আজকের দিনে সারা বঙ্গে বারোয়ারি পুজোর রমরমা; নানা শিল্প সুষমায় সেজে এই পুজো আজ গোটা বিশ্বে প্রসারিত| এই পুজোকে ঘিরে যে রীতিনীতি, ঐতিহ্য,এর পিছনে কিন্তু রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস| কিভাবে শুরু হয়েছিল বারোয়ারি পুজো? কীভাবেই বা সেই সময় নেওয়া হত চাঁদা?সর্বজনীন তকমাই বা কিভাবে পেল এই পুজো?
আসুন দেখে নেওয়া যাক|
সতেরোশো নব্বই সালে, আজ থেকে প্রায় দুশো ষাট বছর আগে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ যুবক প্রথম রাজবাড়ীর ঠাকুরদালান থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে এসেছিল এই উৎসবকে| উৎসব তো সকলের| রাজা-বাদশা অথবা জমিদারদের হাতে কুক্ষিগত তা কেন থাকবে? এক জমিদার বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসে বারো জন বন্ধু মিলে দুর্গাপুজো আয়োজনের সিদ্ধান্ত নতুন করে নেয়| বারো জন ইয়ার বা বন্ধু মিলে পূজার সূচনা করে|সেই থেকে ‘বারোইয়ারি পুজো’ বা ‘বারোয়ারি পুজো’ হিসাবে অভিহিত করা হয়| ঠিক এই ভাবেই একক উদ্যোগের আঙিনা ছেড়ে শারদীয় উৎসব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হল একাধিকজনের উৎসবে| তবে সার্বজনীন রূপ পেতে এই পুজোর আরও একশতক মত সময় লেগেছিল| প্রথমে বাড়ির পুজো, তারপর বারোয়ারি ও পরে অর্থাৎ সবশেষে সার্বজনীন পূজা চালু হয়|
মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী চন্দ্রবংশীয় রাজা সুরথ রাজ্যপাট হারিয়ে প্রথম মাতৃ আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন| কৃত্তিবাসী রামায়ণে বলা আছে যে, রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন| শরৎকালের করেছিলেন অকালবোধন|সেই থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজা| আবার বঙ্গদেশে পুজোর প্রাচীন তথ্য অনুযায়ী রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের ভুঁইয়ারাজা কংসনারায়ণ মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রথম দুর্গাপূজা করেন| এরপর থেকে রাজা, মহারাজা, ভূস্বামীরা শুরু করেন এই পুজো| তবে সেগুলো দেখার অধিকার সবার থাকতো না| কেবলমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন| কথিত আছে, সে সময়ে ওই রাজারাজড়া, জমিদারদের গেটে হাতে চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দাড়োয়ান| কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই চাবুক মারা হত| অথচ সাহেব সুবোদের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অতিথি আপ্যায়নের সুব্যবস্থা| এরপরেই সূচনা হয় গুপ্তিপাড়ার বারোয়ারি পুজোর| কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চন্ডীমঙ্গল কাব্যে” এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়|1761 মতান্তরে 1790 সালে বিপ্লব ঘটিয়েছিল গুপ্তিপাড়া|আর সেই সময় থেকেই শুরু হয় পুজোর চাঁদা নেওয়া|
চাঁদা চাওয়া ও দেওয়া নিয়ে নানা ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই উনিশ শতকের কলকাতার অন্যতম সমাজ চিত্রী ‘হুতোশের’ কোষের বর্ণনা থেকে|
“মহাজন, গোলদার,দোকানদার ও হেটোরাই বেরোইয়ারি পুজোর প্রধান উদ্যোগী| সংবৎসর যা যত মাল বিক্রি ও চালান হয়,  মন পিছু এককড়া, দুকড়া বা পাঁচ কড়ার হিসাবে বারোইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ার গোছের সৌখিন লোকের কাছেই ওই টাকা জমা হয়| তিনি বারোইয়ারি পুজোর অধ্যক্ষ হন, অন্য চাঁদা আদায় করা,চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং তামাশার বন্দোবস্ত করাই তাঁর ভার হয়”|
“চাঁদার বিষয়ে হুতোশের কথায় আরও পাই যে- কানাইবাবু বারোইয়ারি বই নিয়ে না খেয়ে বেলা দুটো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন, কোথাও কিছু পেলেন, কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হলো, কোথাও গলাধাক্কা, তামাশা ও ঠাট্টাও সইতে হলো| কেউ খুশি হয়ে দিয়েছেন স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ বা তিতিবিরক্ত ও প্রকাশ করেছেন| চাঁদা আদায় ব্যাপারটা সেই সময়েও খুব সহজ ছিল না| পুজো উদ্যোক্তারা সকাল থেকেই দরজায় দরজায় হানা দিতেন| হাতে থাকতো কাপড়ের ঝুলি অথবা কাঠের বাক্স| অনেকেই আবার টাকার বিকল্প হিসাবে চাল,ডাল,তরিতরকারি,ফলমূল দিতেন| বহুক্ষণ অপেক্ষার পর দারোয়ানি ঠাট্টাও জুটত|হুতোশ লিখেছেন – ” বারোইয়ারি অধ্যক্ষেরা বেনে বাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোনমতে এক পয়সাও বারোইয়ারিতে খরচ করতে রাজি হলেন না|” আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কড়কড়ে এক হাজার টাকাও জুটত|
“হাটখোলায় গদি, দশ-বারোটা খন্দমালের আড়ৎ, বেলেঘাটার কাঠের ও চুনের পাঁচখানা গোলা,নগদ দশ বারো লক্ষ টাকা দাদন ও চোটায় খাটে “|
এহেন বীরকৃষ্ণ দার মোক্তার কানাইধন দত্ত ছক্কর ভাড়া করে বারোইয়ারি পুজোর চাঁদা তুলতে বেরিয়েছেন| তা গাড়ি হাঁকিয়ে এলেন তিনি আরও এক বড় মানুষের বাড়ির দরজায়| দাড়োয়ান মারফত খবর পাঠিয়ে সেই হুজুর স্থানীয় মানুষটির দেখা পাওয়া গেল| সেই বাবু আবার পুজোর খুব ভক্ত| তিনি পুজোর ক’দিন জামাই, ভাগ্নে, ভগ্নীপতি ও মোসাহেব সহ বারোইয়ারি তলাতেই দিনরাত পড়ে থাকেন|
একালের মত সেকালেও চাঁদার জোর জবরদস্তিতে অতিষ্ট হওয়ারও নানা কাহিনী রয়েছে| সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রিকা যেমন ‘সমাচার দর্পণ’, ‘এডুকেশন গেজেট’, ‘সুলভ সমাচারের’- সম্পাদকীয়তে লেখা হলো, ” প্রায় সকল গ্রামেই বারোয়ারি পুজো লেগেছে|পান্ডা মহাশয়েরা দু-তিন মাস পূর্ব হইতে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত আছেন| কোন নির্দোষী চাঁদা দিতে না পারাতে গুরুদন্ডে দণ্ডিত হইতেছে| কাহাকে মারা হইতেছে, কাহার ঘটি,কলসী, গরু, ছাগল প্রভৃতি কাড়িয়া লওয়া হইতেছে|গরীব দিগের প্রতি বাবুদের এত দৌরাত্ম্য কেন?মানুষজন প্রতিবাদ জানিয়ে পত্র পত্রিকায় চিঠিও পাঠাতেন|”
সেকালে আবার একটা রেওয়াজ শুরু হয়েছিল যে,যাঁরা বিত্তবান হওয়া সত্বেও চাঁদা দিতেও রাজি থাকতেন তাঁদের বাড়িতে শাস্তি স্বরূপ কুমোরটুলিতে পড়ে থাকা প্রতিমা ফেলে দিয়ে যেত পাড়ার ছেলেরা| কোন কোন সময় চাঁদার দাবি  এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ডুলি, পালকির মহিলা সওয়ারিদের পর্যন্ত রেহাই ছিল না| টাকাপয়সা সঙ্গে না থাকলে, “লজ্জাশীলা কুলবালারা বস্ত্রালঙ্কারাদি প্রদান করিয়া মুক্ত হইতেন”|
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এই রকম অসংখ্য “চাঁদা সাধার” ইতিহাস সেকালের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে| তবুও চাঁদাই নয়, বারোইয়ারি তলার পুজোর ধুমধামও কম ছিল না|হাত বিশেক উচ্চ প্রতিমা হত, সোলার ফুল পদ্ম দিয়ে তা সুসজ্জিত থাকত| এছাড়া সন্ধ্যেবেলায় রোজই যাত্রা, পালা গান, সংসাজা, হাফ আখড়াই অনুষ্ঠিত হতো|হাফ আখড়াই অর্থাৎ দেবীর স্তুতি, বিরহ, সখীসংবাদ তারপর খেউড়|চলত কখনও মধ্যরাত আবার কখনও রাতভোর পর্যন্ত|
বঙ্গের বারোইয়ারি পুজোই কালের নিয়মে ধীরে ধীরে সার্বজনীনতা লাভ করে এ কথা বলাই যায়| অনেকে আবার বারোইয়ারি পুজোকেই তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা বলে থাকেন| মতান্তর, যাই থাকুক না কেন, দীর্ঘদিনের সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণ এবং সামাজিক প্রথার ওপর বিদ্রোহ জানিয়েই কিন্তু শুরু হয় বারোইয়ারির শুভ সূচনা|

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights