সাক্ষরতা এবং আমরা


সাক্ষরতা এবং আমরা:-

শুভ্রা চক্রবর্তী

“Education is the backbone of a nation” – শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড । বহুশ্রুত এই প্রবাদটিকে মগজস্থ করলেও মনস্থ করেছি আমরা ক’জন ? ‘ শিক্ষা ‘ গ্রহণের পূর্বশর্ত হল সাক্ষর হওয়া, অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞান যুক্ত হওয়া । আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রাক্কালে একটি কথাই আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় যে, এত আইন প্রণয়ন, এত পদক্ষেপ গ্রহণের পরও;  আমরা ,আমদের দেশ, কি পেরেছে এই মাপকাঠিতে স্ব-সম্মানে উত্তীর্ণ হতে ? সাক্ষরতা বিচারের এই মাপদণ্ডে ভারতবর্ষ ঠিক কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে ? সমগ্র বিশ্বের সাথে তুলনা করলে,আজ ভারতের অবস্থান ঠিক কোথায়? এমনকি প্রত্যেকটি দেশ তাদের নাগরিকদের সাক্ষর করার লক্ষ্যে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার আশানুরূপ ফল কি পেয়েছে আজও ?

সাক্ষরতা দিবস পালনের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, ১৯৬৬ সালের ১৭ই নভেম্বর । UNESCO (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organisation ) ঐ দিন তাদের সাধারণ সভায়, আজকের এই দিনটিকে অর্থাৎ, ৮ই সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে । তবে এই দিনটি উৎযাপন করা শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সাল থেকে ।

এই দিনটিকে উৎযাপন করার মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, সমষ্টি থেকে সমাজের সর্বস্তরে সাক্ষরতার গুরুত্বকে তুলে ধরা । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালিত হয় ।  UNESCO কর্তৃক নির্ধারিত  এ বছরের থিম হল, ‘ Literacy teaching and learning in the COVID-19 crisis and beyond ‘ । এই থিম আজীবন একটি শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের দিক নির্দেশ করে, যার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত যুব এবং প্রাপ্তবয়স্করা । প্রতিবছর বিশ্বের সামগ্রিক পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে এই থিম পরিবর্তিত হয়।   

সাক্ষরতার হার :  ভারত (১৯৫১ – ২০১১) 

সাক্ষরতা একটি অধিকার এবং নিঃসন্দেহে এটি শিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ । কারণ পরবর্তীকালে জাতির সামগ্রিক কল্যাণ বলিষ্ঠ ভাবেই নির্ভর করে এই ‘শিক্ষার ‘ উপর । ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে চালিত  করার অন্যতম হাতিয়ার এই ‘শিক্ষা’ । মানব উন্নয়নের একটি মাপকাঠি স্বরূপ  ‘সাক্ষরতার হার ‘ সূচকটিকে ব্যবহার করা হয় । রাজ্য এনং কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের  মাধ্যমে রাষ্ট্র তার জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহল করে । জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এবং বিভিন্ন সচেতনতা মূলক বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য  চেষ্টা করে । পারিবারিক ক্ষেত্রে, সামাজিক স্তরে তথাপি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে ।

সার্বিক আলোচনার সুবিধার্থে আসুন কিছু পরিসংখ্যান দেখে নিই —

১৯৯১ সালের আদমশুমারির পূর্বে, ৫ বছর বয়সীদের নিরক্ষর বলে গণ্য করা হত । কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী এই সংখ্যাটিকে বাড়িয়ে ৭ বছর করা হয় । এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, একজন ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র পড়তে জানেন, কিন্তু লিখতে না জানেন, তবে তাকে সাক্ষর বলে গণ্য করা হয় না । এই নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ আবশ্যক নয় । যেমন, একজন অন্ধ ব্যক্তিও ব্রেইলির সাহায্যে উতরে যেতে পারেন সাক্ষরতার মানদণ্ডে । ১৯৯১ সাল এবং পরবর্তীকালের আদমশুমারিতে ০-৬ বছরের শিশুদের নিরক্ষর বলে গণ্য করা হয়েছে । এমনকি যদি সেই শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণও করে, তবুও তাকে সাক্ষরতার হার নির্ণয়ের পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না । 

সাক্ষরতার হার কিভাবে নির্ধারণ করা হয় আসুন একবার দেখে নি –

কার্যকরী সাক্ষরতা মান = (৭ বছর এবং ৭ ঊর্ধ্ব বয়সিদের মোট সাক্ষরদের সংখ্যা / ৭ বছর এবং ৭ ঊর্ধ্ব বয়সিদের মোট সংখ্যা ) x ১০০ 

এখানে উল্লেখ্য, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, কেরালায় মোট সাক্ষরতার হার ৯৩.৯১ %, যা ভারতে সব থেকে বেশি । এখানে নারী সাক্ষরতার হারও ৯১.৯৮ % ,যা দেশে সর্বোচ্চ । সেই তুলনায় আমদের পশ্চিমবঙ্গে  মোট সাক্ষরতার হার খুবই কম, মাত্র ৭৭.০৮ %।  পশ্চিমবঙ্গে নারী সাক্ষরতা  ৭১.১৬ % এবং পুরুষ সাক্ষরতা ৮২.৬৭ %  ( সূত্রঃ Office of the Registrar General and Census Commissioner, Ministry of Home Affairs, Government of India)

নারীর সাক্ষরতা এবং ভারত :

‘Educate one man, you educate one person, but educate a woman and you educate a whole civilisation’ – Mahatma Gandhi

বর্তমানে, ভারতে  ১৮৬ মিলিয়ন মহিলা লিখতে বা পড়তে পারেন না । অর্থাৎ, স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোন  ভাষাতেই তারা লিখতে বা পড়তে অপারগ । এই সংখ্যাই আমদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) – এর ক্ষেত্রে আমরা এখনও কতটা পিছিয়ে । যদিও ৬ – ১৪ বছর বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ –এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এই পদক্ষেপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে শিশু শ্রম এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ বেড়ে চলেছে স্কুল ছুটের সংখ্যা । 

ভারত তথা সারা বিশ্বে ‘ ভৌগলিক তারতম্য ‘ এবং ‘ লিঙ্গ বৈষম্য ‘ নারী সাক্ষরতা বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় । যদিও ‘ নিম্ন সাক্ষরতার ফাঁদ’ টপকে সোজা হয়েছে দাঁড়াতে শিখে গেছে আজকের ভারত । ভারত সরকার বেশ কিছু সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । যেমন, মিড ডে মিল প্রকল্প (১৯৯৫), সর্বশিক্ষা অভিযান (২০০১) এবং  শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) ; এই সব প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক মানুষ আজ সাক্ষর হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারছে । যার  ইতিবাচক ফলশ্রুতি আজকের এই ঊর্ধ্বগামী সূচক । কিন্তু নারী শিক্ষার নিশ্চিতকরণ ব্যতিরেকে এই সূচক কখনই কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শ করতে পারবে না । 

নারীর নিরক্ষর থাকা বা শিক্ষিত না হওয়ার কারণ  হিসেবে প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতাকে দায়ী করলে চলবে না । আজ আমাদের সমাজ যে স্থানে দাঁড়িয়ে, তাতে আমাদের মানসিকতাই এর প্রধান কারণ । পিতা মাতা তার কন্যা সন্তানকে সাক্ষর এবং শিক্ষিত করার জন্য এখনও অনিচ্ছুক । বিশেষত, গ্রামে এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি । আজও  কন্যা সন্তান অনেক বাবা-মায়ের কাছে কেবলই  ‘ বোঝা ‘ । আজও শুধুমাত্র বিয়ের জন্য তাদের প্রতিপালন করা হয় । অধিকাংশ পরিবারই  মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আর্থিক ব্যয় করতে অনিচ্ছুক । একে কুসংস্কার বলা উচিৎ নাকি অসচেতনতা ?  সত্যিই জানা নেই । অনেক ক্ষেত্রে আবার নারীদের উপর আরোপিত নানান বাধানিষেধ তাদের শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তবে আশার কথা এটাই যে, বর্তমানে সাক্ষর ‘ মা ‘ -এর থেকে সাক্ষর ‘ কন্যা ‘ -এর সংখ্যা অনেক বেশি ।

সাক্ষরতা ও বিশ্ব :

বিশ্বের অধিকাংশ নিরক্ষর ব্যক্তি বাস করে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকাতে । এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হলেন নারী । নাইজেরে মাত্র ১৯ % মানুষ সাক্ষর, যা বিশ্বে সব থেকে কম । এই দেশটির মাত্র এক-চতুর্থাংশ পুরুষ সাক্ষর । নারী সাক্ষরতা মাত্র ১১ % । একটি ছকের মাধ্যমে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশগুলির তথ্য তুলে ধরা হল :

অন্যদিকে, ঊত্তর কোরিয়াতে সাক্ষরতার হার ১০০ % , যা বিশ্বে সর্বোচ্চ ।  লাতভিয়াতে প্রায়  ৯৯.৯০ % মানুষ সাক্ষর ।   

বিশ্বে যুব (৫ – ২৪ বছর)  সাক্ষরতার সূচক ঊর্ধ্বমুখী । বিগত দুই দশকের মধ্যে এই হার ৮৩ % থেকে বেড়ে ৯১ % হয়েছে  ।  নিরক্ষর যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে ১৭০ মিলিয়ন থেকে ১১৫ মিলিয়ন হয়েছে (unicef.org থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী) । বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ, যুব সম্প্রদায়কে সাক্ষর করার লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলিতে এই হার ৫০ শতাংশেরও কম । এর মূল কারণ ঐ অঞ্চলের দেশগুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা । যার ফলে আজও তারা নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত । 

আঞ্চলিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য থাকার দরুন কম উন্নত দেশগুলিতে সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম এবং পুরুষের সাক্ষরতার হার নারীর সাক্ষরতার তুলনায় অধিক । সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট যুব নিরক্ষরের মধ্যে ৫৯ শতাংশই নারী । পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকাতে নারীর সাক্ষরতার হার সব থেকে কম ।

পরিশেষে, সাক্ষরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা একটি বিশেষ সমাধানের দিকে আলোকপাত করতে পারি । সেটি হল বিদ্যালয়ের  সংখ্যা বৃদ্ধি ও কন্যা সন্তানকে সাক্ষর করার দিকে সচেতনতা বৃদ্ধি করা । যদিও আজকের এই আলোচনার প্রারম্ভেই বলেছিলাম, সাক্ষরতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের কোন আবশ্যকতা নেই । তথাপি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করতে হলে এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে চলবে না । পরোক্ষভাবে হলেও ; বিদ্যালয় সংখ্যা , সাক্ষরতার হারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । নাহলে, ১০০ % সাক্ষরতার লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব । আবার, নারীরা সাক্ষর না হলেও অর্ধেক মানবজাতি নিরক্ষর থাকবে সর্বদা।

মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে সাক্ষরতা এবং শিক্ষা – দুইই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।  স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি, আর্থ – সামাজিক উন্নতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ , নারীর উন্নয়্ন সর্বক্ষেত্রেই সাক্ষরতা অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত । প্রাক্তন ইউ.এন. সেক্রেটারী জেনেরাল কফি আন্নান একদা বলেছিলেন, সাক্ষরতাই হল দুঃখ এবং আশার মধ্যকার সেতু ।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights