বহরমপুর রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে “ভাগীরথী সাংস্কৃতিক উৎসব-২” হয়ে গেল


কোভিড-১৯ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন সামাজিক মানববন্ধন ব্যহত হবার পরে নতুন আলোর আনন্দের খোঁজে এবং পৃথিবীর সকল প্রয়াত কোভিড যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদনের উদ্দেশ্যে বহরমপুরের ‘কালচারাল অ্যান্ড মাল্টি এডুকেশন লিঙ্ক ইন আ্যকশন (ক্যামেলিয়া)’ সংস্থা গত 13, 14, 15 ডিসেম্বর 2021 তারিখ বহরমপুর রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে “ভাগীরথী সাংস্কৃতিক উৎসব-২” আয়োজন করেছিল। পৃথিবীর সর্বপ্রথম কোভিড সেবা যোদ্ধা পথমূকাভিনয় শিল্পী সুজিত কুমার দাস এর পরিকল্পনায় ও ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক এর সহযোগিতায় ভাগীরথী সাংস্কৃতিক উৎসব গত দুই বছর ধরে সুন্দর ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।13 ডিসেম্বর, সোমবার বিকেল 5 টায় ক্যামেলিয়া সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের পুষ্প স্তবক দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে উৎসব এর শুভ উদ্বোধন করেন সুদূর আসাম রাজ্য থেকে আগত ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক আ্যকাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট মূকাভিনয় শিল্পী ও বিশেষ অতিথি মইনুল হক এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুর্শিদাবাদ জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক ও প্রধান অতিথি মহম্মদ নুর ইসলাম। প্রধান অতিথি ‘ক্যামেলিয়া’ সংস্থা ও সুজিত কুমার দাস সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন। উৎসবের প্রথম দিন মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই ‘ক্যামেলিয়া’ সংস্থার নিজস্ব নতুন নাটক ‘বাঁধ ভেঙে দাও পরিবেশিত হয়। রচনা, নির্দেশনা ও বৈরাগী চরিত্রাভিনয়ে সুজিত কুমার দাস অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। অন্যান্য চরিত্র যথাক্রমে নাগরিক- মানসী দাস, পথিক- সাগর চৌধুরী, শিশু যুবরাজ- ভূমিকা দাস তাদের আন্তরিক অভিনয় অনুশীলনের ছাপ রেখেছে। অম্বা চরিত্রে ৭২ বছর বয়সের শোভা রাণী দাস খুব সুন্দর অভিনয় করেছেন। মন্ত্রী চরিত্রে দীপশিখা হালদার মানানসই। কৌশিক ঘটক ও বিশ্বনাথ কর্মকারের আবহসঙ্গীত ভালো হয়েছে। ছন্দবদ্ধো আলোকপাতে শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রবণ সাহা দারুন ভাবে নাটকটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটক দেখে দর্শকবৃন্দ যথেষ্টই খুশী হয়েছেন। এরপর ভূমিকা দাস এর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতা আবৃত্তি শুনে সকলে প্রশংসা করেন। সেদিনের শেষ আকর্ষণ ছিল আসাম রাজ্য থেকে আগত ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক আ্যকাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট মূকাভিনয় শিল্পী মইনুল হক ও তাঁর ছাত্র বিজিত কুমার দাস এর অনন্য মূকাভিনয় প্রদর্শন। দর্শকবৃন্দ মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের দক্ষ অভিনয় শৈলীতে। আবহসঙ্গীতে রতন দাস এককথায় অনবদ্য এবং আলোকসম্পাতে শৈলেন কাকাতি তাঁর দক্ষতা প্রতিফলিত করেছেন। ১৪ ডিসেম্বর উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হয় ‘গোবরডাঙা শিল্পায়ন’ পরিবেশিত স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর গল্প অবলম্বনে আশীষ চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত একটি অসাধারণ নাটক ‘হোমসের দাদাগিরি’ দিয়ে। এই নাটকে নির্দেশক তাঁর দীর্ঘ নাট্যচর্চার মুন্সীয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান নাট্য নির্দেশক। নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছেন শার্লক হোমসের চরিত্রে শৌভিক সরকার। অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পী দীপা ব্রহ্ম আরেকবার প্রমাণ করেছেন যে তিনি থিয়েটারের একজন পরিশীলিত অভিনয় শিল্পী। তিনি সুরেলা কন্ঠে সংলাপ ও উচ্চ স্বরে পাশ্চাত্য সুরের উপস্থাপন করেছেন। সাবলীল দক্ষতায় দারুন অভিনয় করেছেন অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটকে নেপথ্যের শিল্পীগণ সত্যিই অসাধারণ। নাটক অনুশীলনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা শব্দটির সঠিক অর্থ গোবরডাঙা শিল্পায়ন দলের নাট্য প্রযোজনায় প্রতিফলিত হয়েছে। বহরমপুরের দর্শকবৃন্দ দীর্ঘদিন পরে এমন একটি নাটক দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। নাটক শেষে নির্দেশক আশীষ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী দীপা ব্রহ্ম ও ‘গোবরডাঙা শিল্পায়ন’ দলের প্রতিনিধি হিসাবে সম্পাদক তথা অভিনেতা অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় কে ‘ক্যামেলিয়া’ র পক্ষ থেকে স্মারক ও পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্বর্ধিত করা হয়। নাটক শেষ হবার পর জীবনানন্দ দাশ এর ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার আবৃত্তি পরিবেশন করে সকলের প্রশংসা পেয়েছেন। ছোট্ট শিশু রেহান ইউসুফ খুব সুন্দর আবৃত্তি পরিবেশন করেছে। এরপর ক্যামেলিয়া’ সংস্থার পরিবেশনায় সুজিত কুমার দাস নির্দেশিত দুটি মূকাভিনয় ‘চোর পুলিশ’ এবং ‘বন্যপ্রাণী প্রেম’। নির্দেশক সুজিত কুমার দাস দীর্ঘ দিনের মূকাভিনয় অনুশীলনের দ্বারা অসাধারণ নৈপূন্যে ‘চোর’ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সাগর চৌধুরী পুলিশ হয়ে চোরের সঙ্গে সুন্দর যুগলবন্দী করেছে। ‘বন্যপ্রাণী প্রেম’ মূকাভিনয়টি বন্যপ্রাণী ও বন্য প্রাণ সংরক্ষণ বিষয়ে খুব সুন্দর ভাবে নির্দেশক সুজিত কুমার দাস উপস্থাপনা করেছেন। অভিনয়ে পাখি- ভাগীরথী চৌধুরী, হরিণ- ভূমিকা দাস, বাঘ- দীপশিখা হালদার, শিকারি- সাগর চৌধুরী, ভালো মানুষ- ঋত্বিক হালদার নিয়মিত মূকাভিনয় অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পেরেছে। আবহসঙ্গীতে কৌশিক ঘটক তাঁর নিজ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। সবশেষে অধ্যক্ষ্য ইউসুফ নবীর তত্ত্বাবধানে ভরতপুর কনিজা হ্যান্ডিক্যাপ স্কুল পরিবেশিত অরূপ রতন দাস পরিচালিত মন মাতানো নৃত্যানুষ্ঠানে দর্শকবৃন্দ আপ্লুত হয়েছেন।১৫ ডিসেম্বর উৎসব এর শেষ দিন পুষ্পেন্দু রায় আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গান পরিবেশন করে প্রশংসিত হয়েছেন। ছোট্ট মেয়ে দীপশিখা হালদার সুন্দর আবৃত্তি পরিবেশন করে। এরপর ছোট্ট মেয়ে ভূমিকা দাস আটখানা আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গান পরিবেশন করে দর্শকবৃন্দের অকুণ্ঠ প্রশংসা আদায় করে। অনেকেই বলছেন আগামীদিন বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদে আরও একজন ভালো সঙ্গীত শিল্পী তৈরী হচ্ছে। যন্ত্রসঙ্গীত সহযোগী শিল্পী হিসাবে কৌশিক ঘটক, অক্টোপ্যাডে সন্দীপ ভট্টাচার্য, গীটারে রাকেশ আচার্য ও তবলাবাদ্যে সুজিত কুমার দাস শিল্পীদের সঙ্গে অপূর্ব ও যথার্থ সঙ্গত করেছেন। সবশেষে ছিল প্রকাশ বিত্তারের পরিচালনায় মুর্শিদাবাদ রায়বেশে আ্যকাডেমীর অসাধারণ নৃত্য। মনোমুগ্ধকর এই দক্ষ বীররসের নৃত্য উপস্থাপন দেখে দর্শকবৃন্দ অভিভূত হয়েছেন। পরিশেষে ‘ক্যামেলিয়া’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তথা বিশিষ্ট মূকাভিনয় ও নাটক শিল্পী সুজিত কুমার দাস উপস্থিত দর্শকবৃন্দের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে “ভাগীরথী সাংস্কৃতিক উৎসব-২” এর সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সকলে ভীষণ আনন্দ নিয়ে আগামী ভাগীরথী সাংস্কৃতিক উৎসব এ উপস্থিত হবার আশা নিয়ে বিদায় গ্রহণ করেন।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights