ক্যান্সার রোগীদের জীবনে নতুন দিশা দিতে চলেছে মেডিকার ‘ব্লাডার ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপ’


ইন্দ্রজিৎ আইচঃ এই বছর ব্লাডার ক্যান্সার সচেতনতা মাস উপলক্ষ্যে মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট হসপিটাল চেন, শুক্রবার ১৩ই মে একটি বিশেষ ঘোষণা করল। হসপিটালের তরফে জানানো হয়েছে যে তারা একটি ব্লাডার ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করেছে মেডিকা সুপার স্পেশালটি হসপিটালে ব্লাডার ক্যান্সার জয়ীদের জন্য। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে ডঃ অভয় কুমার, ইউরোলজি বিভাগের প্রধান, সার্জিক্যাল অনকোলজি এবং রোবোটিক সার্জারি, মেডিকা সুপার স্পেশালটি হসপিটাল ব্লাডার ক্যান্সার সম্পর্কিত বিশেষ তথ্য, রোগের উপসর্গ, ভুল ধারণা, রোগী সম্পর্কে সংখ্যাতত্ত্বের দিকটি তুলে ধরেন। এছাড়াও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাস্তব জীবনের নায়কেরা যারা সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, সামাজিক জটিলতা এড়িয়ে এবং আর্থিক সমস্যা সামলে ক্যান্সারকে হারিয়েছেন এবং কোন সময়েই হেরে যাননি। এই ঘোষণার পর ক্যান্সার জয়ীরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন উপস্থিত সকল অতিথিবৃন্দের জন্য।

এই ঘন্টা দেড়েকের অনুষ্ঠানে আলোচনা হয় যেখানে উপস্থিত সকলকে জানানো হয় ক্যান্সারের উপসর্গ থেকে বিভিন্ন টেকনিক্যাল দিক যা সুস্থতার ক্ষেত্রে খুব জরুরি। আজ মেডিকা হসপিটালে সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডঃ অভয় কুমার( ইউরোলজি বিভাগের প্রধান, সার্জিক্যাল অনকোলজি এবং রোবোটিক সার্জারি, মেডিকা সুপার স্পেশালটি হসপিটাল) বলেন,” ডোন্ট গো রেড টু আ ডক্টর – এই বছর ব্লাডার ক্যান্সার সচেতনতা মাসের থিম এটি। মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের জীবনে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে লজ্জা পেলে চলবে না। আমরা অনেকে সময়েই স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা বা প্রফেসনাল সাহায্য নেওয়া এড়িয়ে যেতে চাই যেমন মূত্রনালীর সংক্রমণের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। স্রেফ সচেতনতার অভাবে, ভারতের প্রতি বছর এই ধরনের ২০,০০০ নতুন কেস হয়ে থাকে। যদি আগে ধরা পড়ে, তাহলে এই ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব। তবে কিছু ক্ষেত্রে টিউমার আবার করে হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, তাই নিয়মিত নজরদারিতে থাকা খুব প্রয়োজন।”

এছাড়া উনি বলেন, “ব্লাডার ক্যান্সার একটি সাধারণ ক্যান্সার যার চিকিৎসায় প্রয়োজন দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত চেকআপ। স্বাভাবিকভাবেই রোগীর ও তার পরিবারের ভীষণ উদ্বেগ হয় এবং স্ট্রেস তৈরি হয়। সঠিক বা দরকারী মানসিক অবস্থার জন্য, যারা সেই রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদের তরফ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন। এর জন্য একটি সাপোর্ট গ্রুপের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না, যা আমাদের পূর্ব ভারতে বিরল বলা যেতে পারে। তাই ব্লাডার ক্যান্সার সচেতনতা মাসে আমরা এই সাপোর্ট গ্রুপ বানিয়েছি যার মাধ্যমে আমরা রোগীদের এবং চিকিৎসায় যুক্ত, তাদের সবাইকে রোগ, চিকিৎসা এবং চিকিৎসার ফলাফল নিয়ে সাহায্য করতে পারি। এর ফলে একটি ফোরাম বানানো সম্ভব হবে যার মাধ্যমে ব্লাডার ক্যান্সার জয় করেছেন যারা, তারা একজোট হয়ে নিজেদের জীবনের কাহিনী ও চিন্তা একে অন্যকে বলতে পারবেন। আর অবশ্যই উপলব্ধি করবেন যে তারা কোনভাবেই একা নন। “

মেডিকা, পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় এবং দ্রুত বেড়ে ওঠা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অগ্রণী গ্রুপ, এই মুহূর্তে পরিকল্পনা করছে কলকাতায় বিশ্বমানের ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলার যেখানে সেরা ডাক্তাররা থাকবেন। মেডিকা মনে করে যে শুধুমাত্র উদ্ভাবন বা প্রযুক্তি দিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি সেরা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এই জন্য মেডিকা ক্যান্সার পরিষেবায় শুরু করেছে ব্লাডার ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপ। এই প্রয়াস সেই সমস্ত মানুষকে কুর্নিশ জানানো যারা লড়াই করেছেন এবং হারিয়েছেন ক্যান্সারকে। মেডিকার তরফ থেকে একটি অনুষ্ঠানে এরকম ৩০ জন মানুষকে ডাকা হয়েছিল যারা ব্লাডার ক্যান্সারকে হারিয়েছেন। এছাড়া একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তাদের জন্য।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের প্রাক্তন কর্মী ৭০ বছরের দেবপ্রসাদ ঘোষের ব্লাডার ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় জানা যায় যে তার একটি কিডনি ঠিক ভাবে কাজ করছে না। রেডিক্যাল সিস্টেকটমির মাধ্যমে তার ব্লাডার বাদ দেওয়া হয় এবং বাম দিকে নেফ্রকটমি, বাম কিডনি, এবং পেটের মধ্যে একটি ফুঁটো করা ব্যাগের পরিবর্তে যেখানে প্রস্রাব তৈরি হয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ইলিয়াল কনডুইট অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার এবং পরবর্তী সময়ে সেরে ওঠার পর্বে কোন সমস্যা হয়নি। বর্তমানে কোন জটিলতা ছাড়াই সুস্থ জীবনযাপন করছেন তিনি।

হাওড়ার বাসিন্দা বিশ্বনাথ দে- এর প্রথমে ধরা পড়েছিল হিমাটুরিয়া অর্থাৎ প্রস্রাবে রক্ত। এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে ওনার ব্লাডার টিউমার রয়েছে। এর পর চিকিৎসার পদ্ধতি হিসেবে ওনার এন্ডোস্কোপিক মাধ্যমে ব্লাডার টিউমারের ট্রান্সইউরিথ্রাল রিসেকশন (টিইউআরবিটি) হয়। বায়োপসির পর নিশ্চিত হয় যে ওনার ব্লাডার ক্যান্সার হয়েছে। এরপর ডঃ অভয় কুমার এবং তার টিমের অধীনে নিওব্লাডার রিকনস্ট্রাকশন করা হয়, অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি নতুন ব্লাডার বানানো হয়। এখন উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, যিনি পুলিশে চাকরিরত, গত ১৫ বছর ধরে ব্লাডার ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছেন। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল অবধি ওনার চিকিৎসা হয়েছে। ২০১৬ সালে ওনার ফের ব্লাডার ক্যান্সারের উপসর্গ ফিরে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই উনি ভেঙে পড়েন। এরপর সাইটোস্কপি ও টিউআরবিটি (TURBT) টার্বোস্কপি অস্ত্রোপচার হয় ওনার। এরপর চার বছর নিয়মিত চেকআপের মধ্যে ছিলেন তিনি। এখন তিনি ফিট এবং সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছেন।

রমেন মুখার্জির ব্লাডার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর মেডিক্যাল সিস্টেকটমি ইলিয়াল কনডুইট অস্ত্রোপচার (ব্লাডার বাদ দেওয়া হয় এবং পেটের বাইরে একটি ব্লাডার লাগিয়ে দেওয়া) হয়। কেমোথেরাপির এবং নিয়মিত চেকআপের পর এখন সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছেন তিনি।

যারা ব্লাডার ক্যান্সার জয় করেছেন এবং সুস্থ রয়েছেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন মেডিকাতে। তারা আলাদা করে বলেন হাসপাতালের সেই সুযোগ সুবিধার কথা যা ক্যান্সার চিকিৎসা সংক্রান্ত স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এছাড়া উপস্থিত অতিথিদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল, স্টাফ এবং রোগীরা সকলেই সেটা উপভোগ করেন। বলাই বাহুল্য, মেডিকার স্টাফেরা সামাজিকতা এবং সাহায্যের মর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের কান্ডারী হল সেই সব মানুষেরা যারা নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছেন।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights