গোপাল বিশ্বাস, নদীয়া- শনিবার সকাল থেকেই তালা বন্ধ হয়ে গেলো মা কালী সহ প্রায় সকল দেবী মায়ের মন্দির, যেখানে পাকা মন্দির নেই সেখানেও দেবী মূর্তীকে শাড়ি বা চাদর দিয়ে রাখা হলো ঢেকে ! কারণ শনিবার থেকে শুরু হয়েছে অম্বুবাচী। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ থেকে মৃগশিরার নক্ষত্রের তিথিপদ শেষ হলে অম্বাবুচি শুরু হয়। এবছরও ৭ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত অম্বুবাচী চলবে এবং এই কয়দিন মন্দির সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। ধরা হয় এই সময় মা ধরিত্রী তথা মা সতীমাতা রজশলা হন। এই তিন দিন, সকল মায়ের মন্দির বন্ধ থাকে,নিত্যপুজো এবং সেবা সবটাই হয়েছে বাইরে থেকে। আজ আবারও মা সকল ভক্তদের সামনে দেখাদেন। আসামে কামাখ্যার পূজা অঙ্গচ্ছেদের সময় এই স্থানে দেবীর গর্ভ এবং যোনি পড়েছিলো বলেই কথিত আছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে প্রতিবছর আষাঢ় মাসের 7 তারিখ অম্বুবাচী পালিত হয় শাস্ত্র মতে সূর্য যে বারে ও যে সময়ে মিথুন রাশিতে গোচর করে তার পরের দিন সেই বারই পালিত হয় অম্বুবাচী। আষাঢ় মাসের মৃগশিরা নক্ষত্র তিনটি পর্যায়ে শেষ হলে ধরিত্রী ঋতুমতী হন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এসময় ধরিত্রী ঋতুমতী হন বলেই শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে বসুন্ধরা তাই অম্বুবাচী সময় হাল ধরাও নিষিদ্ধ। এই তিনদিন সময় কোন শুভ অনুষ্ঠান করা হয় না, বিবাহ উপনয়ন এমনকি কোনো মন্দিরেও প্রবেশ করা যায় না। এই পূজায় মায়ের কাছে কিছু চাইলে তার সব ইচ্ছে পূরণ করেন মা এমনটাই বিশ্বাস ভক্তবৃন্দ দের। অসমের কামাক্ষ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে উৎসবও পালন করা হয়। শাস্ত্রমতে অম্বুবাচীর ৩ দিন সর্বপ্রকার মাঙ্গলিক এবং শুভ কর্ম যেমন বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, গৃহ প্রবেশ, গৃহ আরম্ভ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। কৃষিকার্য সংক্রান্ত কোনও কাজ এই সময় করা হয় না। চতুর্থ দিন থেকে কোনও বাধা থাকে না। দেবী কামাক্ষ্যা মন্দিরে এই তিথিতে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। অম্বুবাচীতে কী করবেন:- এ সময় দেবী মূর্তি বা পট লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত। অম্বুবাচী শেষ হওয়ার পর দেবীর আসন পাল্টে, স্নান করিয়ে পুজো দেওয়া উচিত। নিবেদন করুন দুধ আম এতে শুভ ফল মেলে। এ সময় গুরুপুজো করা উচিত বলে মনে করা হয়। অম্বুবাচীতে তুলসীর গাছের গোড়া মাটি দিয়ে উঁচু করে রাখুন। অম্বুবাচীতে যে কাজ করা অনুচিত:- বৃক্ষ রোপণ, কৃষি কাজে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার শুভ কাজ করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। বিবাহ,গৃহপ্রবেশ তো নয়ই। মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়াই পুজো করুন। ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো করতে হয়। বাড়ি, জমি বা দামী জিনিস কিনবেন না। সাপকে আঘাত করবেন না। চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ রাখুন।
এবার শুনুন অম্বুবাচীর কাহিনী:-
একদা শিব আর পার্বতী বৃষ-আরোহনে ভ্রমণে বেরিয়েছেন। হৈমবতী প্রশ্ন করলেন, “মহেশ্বর ! তোমার গলায় কেন হাড়মালা ? ভস্ম মাখো কেন ? কেন দিগম্বর আর কেনই-বা ভিক্ষুক ?” শিব বললেন, “প্রিয়ে ! তুমি মনের সুখে যতবার দেহত্যাগ করেছ, তা স্মরণ করে চিতাভস্ম মাখি। কঙ্কালের কণ্ঠহার পরি। উদাসীন হয়ে ভিক্ষা করি। আর শোকলাজহীন মহাযোগীর বস্ত্রে কিবা কাজ ?” শিবের বচনে দেবীর বারংবার জন্মমৃত্যু, অর্থাৎ দেবীর অনিত্যতার প্রতি ইঙ্গিত ছিল। শক্তির প্রতি শৈবগণের এই কটাক্ষ বহুকালের। দেবী ক্রুদ্ধ হলেন। নিজের তত্ত্ব জানানোর জন্য তৎক্ষণাৎ শিবকে এক রক্তনদী দেখালেন। ভয়াবহ রক্ত-তরঙ্গিনী দেখে শিব তো হতবাক ! এর রহস্য-ভেদ করার জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন তিনি। কিন্তু ঈশ্বরীর এমনই মায়া, কিছুতেই শিব এই নদীর তত্ত্ব অনুধাবন করতে পারলেন না। অগত্যা তিনি দেবীরই শরণাপন্ন হলেন। দেবী সহাস্যে বললেন, “যতবার আমি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে প্রসব করেছি, ততবারের প্রসবরক্ত নদীর আকারে অদ্যাবধি বয়ে চলেছে।” শুনে চমকে ওঠেন শিব। আরম্ভ করলেন দেবীস্তব।
“হাসি কহে নারায়ণী হরি হর পদ্মযোনি
প্রসবিনু আমি যত বার ॥
সেইত রক্তের নদী বহে হর অদ্যাবধি
শুনি হর হৈলা চমকিত ।
দেবীরে করিল স্তব শ্রীকবিবল্লভ শুভ
[বিরচিত] নৌতন সঙ্গীত ॥”
শক্তিপারম্যের চরমতম এই উপাখ্যানটি লিখেছিলেন প্রাণরাম কবিবল্লভ, তাঁর ‘কালিকামঙ্গল’ কাব্যে। নিখিলপ্রসূতির আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।