গোলায় ধান থাকলেই খুশি কান্দীর মনোহরপুর


রাজেন্দ্র নাথ দত্ত:মুর্শিদাবাদ: ‘আমাদের গোলা যেন থাকে শস্যে ভরা।’ সমৃদ্ধির দেবী, লক্ষ্মীর কাছে কান্দির মনোহরপুরের প্রার্থনা বলতে এইটুকুই। প্রায় একশো বছর ধরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করে আসছেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। টানা তিন দিন ধরে ওই পুজোকে ঘিরে মেতে থাকে গ্রামের ২৪৫টি পরিবার।বহু বছরের প্রথা মেনেই ওই পুজোর দায়িত্বে থাকেন গ্রামের কিছু বিশিষ্ট মানুষ। স্থানীয় ভাবে যাঁরা ‘মোড়ল’ বলে পরিচিত। তাঁদের নিয়ে পুজো কমিটি তৈরি করা হয়। এ বারে যেমন পুজোর দায়িত্বে আছেন উত্তম দাস, অশোক মণ্ডল, অজয় ঘোষ, কর্ণ মণ্ডল, নবকুমার ঘোষ ও তপন ভট্টাচার্যেরা। এত বছর ধরে মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া মন্দিরে পুজো হত। গত বছর থেকে মন্দির পাকা করার কাজ শুরু হয়েছে। এখন কাজও প্রায় শেষের দিকে। মনোহরপুরে একটি কথা প্রচলিত আছে—গোলায় ধান থাকলে সব বিপদ থেকেই মুক্তি মিলবে। তাই গ্রামের প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে লক্ষ্মীর আরাধনায় উপবাস করেন।
উত্তম দাস, অশোক মণ্ডলদের কথায়, ‘‘কান্দি বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে পরিচিত। বহু বার বন্যায় খেতের ফসলও নষ্ট হয়েছে। কিন্তু মা লক্ষ্মীর আশির্বাদে কোনও বারই আমাদের গোলা খালি হয়নি।’’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রামে একমাত্র ভট্টাচার্য পরিবারে দুর্গাপুজো হয়। সেটা বাদ দিলে এই গ্রামে সবথেকে বড় উৎসব লক্ষ্মীপুজোকে ঘিরেই। পুজো উপলক্ষে গোটা গ্রাম আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে। মণ্ডপও সাজানো হয়েছে যত্ন করে। পুজো উপলক্ষে বসবে মেলা, কবিগান ও যাত্রার আসর। প্রথম দু’দিন ধরে পুজো প্রাঙ্গণে নানা অনুষ্ঠান হবে। শেষ দিন গ্রামের বাইরে কান্দি-বহরমপুর রাজ্য সড়কের পাশে ভবাসিয়া পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। তার আগে প্রায় ঘন্টা খানেক আতসবাজি পোড়ানো হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।মনোহরপুর তো বটেই, পুরন্দপুর, রাঙামাটি, বাটী, গোকর্ণ, খড়গ্রাম এমনকি কান্দি থেকেও বহু মানুষ ভিড় করেন ওই পুজো দেখতে। অশোক মণ্ডল, অজয় ঘোষদের কথায়, ‘‘দুর্গাপুজো নয়, আমাদের এখানে লক্ষ্মী পুজো ধুমধাম করে হয়। কর্মসূত্রে ভিন্‌দেশে থাকা ছেলেরা এই সময়েই ঘরে ফেরে। আত্মীয়েরাও এই সময় চলে আসেন।”গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এসেছেন আত্মীয়-পরিজন। দুর্গাপুজো নয়, শতাব্দীপ্রাচীন গ্রামের লক্ষ্মীপুজোই বাসিন্দাদের কাছে বছরের সেরা উৎসব। শুধু ওই গ্রাম নয়, প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারাও আনন্দে শামিল হয়েছেন। পুজোকে ঘিরে চারদিন ধরে চলবে উৎসব। আলোয় সেজেছে গোটা গ্রাম। কর্মসূত্রে বাইরে থাকা বাসিন্দারা গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এবছর ১১৩ বছরে পা দিল ওই পুজো। আগে গ্রামের দাস পরিবারের পক্ষ থেকে পুজো করা হতো। এরপর দাস পরিবার গ্রাম থেকে চলে যায়। তখন থেকে গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই পুজো চালিয়ে আসছেন। পুজো কমিটির সভাপতি অজয় ঘোষ বলেন, গ্রামে হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করলেও একটি মাত্র কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়। সেখানে গ্রামের সকলেই অংশ নেন। দুর্গাপুজো নয়, এই গ্রামে লক্ষ্মীপুজোই সেরা উৎসব।
পুজো উপলক্ষে চারদিন ধরে এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাউল, কীর্তন, কবিগান, যাত্রাপালা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাও করা হচ্ছে। পুজো কমিটির সম্পাদক তপনকুমার ভট্টাচার্য বলেন, গত দু’বছর করোনার কারণে সেভাবে অনুষ্ঠান করা যায়নি। তবে এবছর ঠাসা অনুষ্ঠান রয়েছে। পুজোর প্রতিদিন দর্শক সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে পুজো উপলক্ষে বাইরে থাকা গ্রামের বাসিন্দারা ফিরে এসেছেন। প্রতিটি বাড়িতেই এসেছেন আত্মীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা জন্মেঞ্জয় মণ্ডল বলেন, পুজোর সময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে অনেক আত্মীয় আসেন। পুজোর ক’দিন গ্রামে ব্যাপক ভিড় থাকে। পুজো উপলক্ষে গোটা গ্রামে আলোর রোশনাই রয়েছে। রকমারি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে নারকেলের নাড়ু তৈরি হচ্ছে। চারদিনের এই পুজোর প্রতিমা বিসর্জন হয় গ্রামের শেষপ্রান্তের ভবাশিয়া পুকুরে। প্রথা অনুযায়ী বিসর্জনের দিন পুকুরপাড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য মেলা বসে। সেখানে আতসবাজি প্রদর্শন করা হয়। মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দারা লক্ষ্মীপুজোর জন্য বছরভর অপেক্ষা করেন। রবিবার সকাল থেকেই গ্রামে লোকজন আসতে শুরু করেন। রাতে গ্রামে ব্যাপক ভিড় জমে।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights