ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সাক্ষী যে জমিদারবাড়ি তা কালের নিয়মে ভগ্নস্তুপে পরিণত…


সজল শীলের রিপোর্টঃ শান্তিনিকেতনের জন্ম ইতিহাসের সাথে যে জমিদার বাড়ি জড়িয়ে আছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমন ও ব্রাহ্ম উপাসনা, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের শ্রীকণ্ঠ সিংহ, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্দেশক মৃণাল সেনের খন্ডহর সিনেমার মত বহুবিধ ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সাক্ষী যে জমিদারবাড়ি তা কালের নিয়মে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে কয়েক দশক থেকেই। স্থানীয় মানুষ সহ শান্তিনিকেতনে আগত পর্যটকদের একটা বড় অংশের কাছে এই জমিদারবাড়ি বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিং স্পট হিসাবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েক বছর ধরে বোলপুরের কাছে রাইপুর গ্রামের সিংহ পরিবারের এই জমিদারবাড়ি ক্রমে পরিসর ভিত্তিক উপস্থাপনা ক্ষেত্র (পারফর্মিং স্পেস) হিসাবেও গুটিগুটি পায়ে এক পৃথক পরিচয় গড়ে তুলছে। গ্রামীণ যুবকদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান রাইপুর যুব সংঘ ও গ্রামের বসবাসরত সিংহ পরিবারের সদস্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় আড়াইশ বছরেরও বেশি পুরানো এক ভগ্ন স্থাপত্য আজ নতুন পরিচয় অন্বেষণে। তারই অঙ্গ হিসাবে জমিদারবাড়ির জীর্ণ অন্দরমহলে ইন্সটলেশন আর্ট, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও নাট্য উপস্থাপনার মত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বহুবার। সম্প্রতি জুন মাসের ৮ তারিখে (শনিবার) কবরডাঙা মুক্তধারা নাট্যদল তাদের নাট্য উৎসবের জন্য জমিদারবাড়ির এই পরিসরকেই বেছে নিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সহযোগিতায় ও রাইপুর যুব সংঘের আয়োজনে এই দিন বিকাল পাঁচটা থেকে বসে ছিল নাটকের আসর। উৎসব উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্য মলয় ঘোষ। মলয় ঘোষের উদ্বোধনী বক্তব্যের পরে অভিনীত হয় পরপর চারটি নাটক। বীরভূমের ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল বোলপুর নাট্যসারথি প্রবীর দত্তের লেখা ‘মূল্যবোধের সংকট’ নাটকটি উপস্থাপিত করে। প্রদীপ পুরোহিত নির্দেশিত এই নাটকে সব কিছু ছাপিয়ে জিতে যাওয়া বাজার অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে মূল্যবোধের অবনমনের এক চিত্রের অভিঘাত সঞ্চারিত হয় দর্শক মনে। দ্বিতীয় নাটক ছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার ইলোরা নাট্যদলের ‘একদিন প্রতিদিন’। সুন্দরম পুরস্কার প্রাপ্ত মলয় ঘোষ রচিত ও নির্দেশিত এই নাটকের রন্ধে রন্ধে কৌতুকের মোড়কে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, স্বার্থান্বেষী রাজনীতি ও বোধহীন বাজার চলতি মানসিকতার বহু কানাগলি সরল ভাষ্যে উঠে আসে। তৃতীয় নাটক ছিল কবরডাঙা মুক্তধারা নাট্যদলের ‘মনসা কথা’। কিঙ্কিণী সেনগুপ্তের একক অভিনয় ও দলের অন্যান্য সদস্য-সদস্যাদের আবহে অংশগ্রহণে এই নাটকে উঠে এসেছে সাধারণ মেয়েদের নিপীড়নের ও লড়াইয়ের কাহিনী। উৎসবের অন্তিম নাটক ছিল বোলপুর নৃত্যনিকেতন ডান্স গ্রুপ অ্যান্ড স্কুলের ‘মৃত্যু’ যা কিনা অভিষেক দত্ত রচিত এবং নির্দেশিত। শহর ছাড়িয়ে গ্রামীণ এলাকাগুলিতেও ড্রাগের নেশা যখন ছড়িয়ে পড়ছে তখন এই মারণ নেশার কারণ ও প্রতিকারের শেকড় পর্যন্ত পৌঁছে উৎসবে উপস্থিত গ্রামীণ দর্শকদেরই প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করিয়ে দেয় এই নাটক। এমন একটি ঐতিহাসিক ভগ্নস্তুপে নাট্য উৎসবের আয়োজন প্রসঙ্গে উৎসবের সমন্বয়কারীদের মধ্যে ড. অঙ্কুশ দাস বলেন “বাংলার শহর কেন্দ্রিক নাট্যচর্চার বাইরে বেরিয়ে সাধ্যের মধ্যে গ্রামীণ দর্শকদের কাছে বর্তমান সময়ের নাট্যচর্চার স্রোতকে পৌঁছে দেওয়া এই আয়োজনের অন্যতম লক্ষ্য। সেই সাথে বিকল্প পরিসর ভিত্তিক নাট্যচর্চার হাত ধরে গ্রামীণ অজনপ্রিয় ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে নিয়ে জনমানসে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চার সহ পরিসর ভিত্তিক নাট্যচর্চার মাধ্যমে ভিন্ন বা সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবহারিক বয়ান নির্মাণও আরও এক উদ্দেশ্য”। কবরডাঙা মুক্তধারা নাট্যদলের পক্ষ থেকে দলের সম্পাদক রশ্মি ঝা বলেন “এই রকমের এক আন্তরিক পরিবেশে অভিনয়ের আয়োজন করা সত্যিই এক অন্য রকমের অনুভূতি। গ্রামীণ মানুষের সামনেই তাদের কথা নাট্য আঙ্গিকে বলতে পারার তৃপ্তিও আছে। দলের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আর রাইপুর যুব সংঘ ও গ্রামবাসীরাও যে ভাবে এই উৎসব আয়োজনে আমাদের পাশে থেকেছে তাতে আমরা আপ্লুত। আগামী দিনেও এই জমিদারবাড়িতে আরও কাজ করার ইচ্ছে রইল”।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights