‘‌স্কুইন্ট’‌ বা ‘‌ট্যারা’‌ চোখ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে, দেরি করলে দৃষ্টিশক্তি কমে অ্যামব্লায়োপিয়া হওয়ার সম্ভাবনা


ডাঃ সৌমী মল্লিক (‌অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার, রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি‌)‌

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

পেডিয়াট্রিক অপথ্যালমোলজিস্ট শঙ্করাজ্যোতি আই ইনস্টিটিউট, নিউটাউন, নিউটাউন কিউব বিল্ডিংয়ের সাত তলা সোম ও বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা, শনিবার সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত

‘‌স্কুইন্ট’‌ বা ‘‌ট্যারা’‌ চোখ দেখলেই আমরা বলি ‘‌লক্ষ্ণী ট্যারা’‌‌‌‌। মানে, এটাই স্বাভাবিক, আলাদা করে গুরুত্ব দিই না। ট্যারা হলে স্কুলে সহপাঠীদের কাছে হাসির খোরাক হতে হয়। অনেক সময় বিয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু এর যে সঠিক চিকিৎসা আছে, তা অধিকাংশই লোকেই জানেন না। ঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে ট্যারা চোখ ঠিক করা সম্ভব। শিশুদের যত তাড়াতাড়ি ট্যারা চোখের সমস্যা মেটাতে চিকিৎসা শুরু করা যাবে ততই ভাল ফল পাওয়া যাবে। সচেতনতার অভাবে বাবা–মায়েরা ঠিকমতো বুঝেই উঠতে পারেন না যে তাঁদের সন্তানের চোখ ট্যারা। আর যদিও বা বোঝেন, সেক্ষেত্রে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে অনেক দেরি করেন। সুতরাং, সময় থাকতে থাকতে সচেতন হওয়াই সন্তানের জন্য উপকারী। ‘‌ট্যারা’‌ শব্দটি মূলত একটি চোখের সমস্যা বোঝায়। অনেক সময় দুই চোখেও হতে পারে। চোখের পাতা বা চোখের পেশি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পারায় চোখ বাঁকা হয়ে যায়। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন জন্মগত সমস্যা, চোখের পেশির দুর্বলতা, আঘাত বা অন্য শারীরিক সমস্যা।
ট্যারা মূলত দুই রকমের হতে পারে। ইসোডিভিয়েশন, অর্থাৎ চোখের ভিতর দিকে ট্যারা, বা এক্সোডিভিয়েশন, অর্থাৎ চোখের বাইরের দিকে ট্যারা। যে কোনও বয়সেই ট্যারা হতে পারে। জন্ম থেকেই হতে পারে আবার একটু পরিণত বয়সেও দেখা যায়। চোখ নড়াচড়া করাতে নার্ভ বা পেশি সাহায্য করে। জন্মগত কোনও একটা নার্ভে বা পেশিতে দুর্বলতা থাকলে তাকে ল্যাটরাল রেক্টাস মাসল বলে। তার জন্য চোখ ট্যারা হয়ে যায়। শিশুটি হয়তো চোখের নার্ভ বা পেশির দুর্বলতা নিয়েই জন্মেছে। এমনও হয়েছে ৩–৪ কিংবা ৬ মাস বয়সে যখন বাবা মায়েরা আসছেন, তখন দেখছি, তাঁদের সন্তানের একটা চোখ বা দুটো চোখই ট্যারা হয়ে গেছে। আমরা এরকমও কেস পেয়েছি। আবার রেটিনোব্লাস্টোমা বলে চোখে একটি ক্যান্সার হয়। তার জন্যও ট্যারা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কনজেনিটাল ক্যাটার‌্যাক্ট বা জন্ম থেকেই ছানির সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলেও চোখ ট্যারা হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, জন্ম থেকেই কিংবা তিন–চার মাস বয়সের পর থেকে চোখের মাঝের অংশ সাদা হয়ে গেছে। এইরকম হলে দ্রুত চিকিৎসা দরকার। কারণ চোখের ভিতরে আলো পৌঁছালে ট্যারা হবে না। প্রি–ম্যাচিওর ডেলিভারি হলে অনেক সময় এসএনসিইউ, পিকুতে বেশি অক্সিজেন সাপোর্টে রাখলে রেটিনার ক্ষতি হতে পারে (‌রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচিওর)‌। কনজেনিটাল গ্লকোমা হলে চোখে প্রেশার বেড়ে মণি বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে। স্কুলে গেলে শিশুর বোর্ড দেখতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে তখন শিক্ষকরা অভিভাবকদের বলছেন চোখ পরীক্ষা করানোর জন্য। আগে হয়তো শিশুটির চশমার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটা তখন দেওয়া হয়নি। সেই কারণে ট্যারার দিকে অগ্রসর হয়েছে। জন্মের দুই–তিন বছর বাদে চিকিৎসকের কাছে রোগটি ধরা পড়ল। এইভাবে অনেকটা দেরি হয়ে যায়।
সব শিশুর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়বে এমনটা নয়য কিসের জন্য ট্যারা হয়েছে সেই কারণটা আগে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। মণিতে কোনও সমস্যা থাকতে পারে, জন্মগত রেটিনার সমস্যা, গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা থাকায় জন্মেছে ছানি নিয়ে, জেনেটিকও হতে পারে। ইইউএ (‌এক্সামিনেশন আন্ডার অ্যানাস্থেশিয়া)‌, অর্থাৎ শিশুকে অজ্ঞান করে তারপর চোখের ভিতরে পরীক্ষা করে দেখি, কোন সমস্যার কারণে চোখ ট্যারা হয়েছে। সবার আগে ভাল করে কেস হিস্ট্রি নিই। তারপর পরীক্ষায় কারণ খুঁজে বের করা হয়। সেই মতো চলে চিকিৎসা।
যার চশমার প্রয়োজন তাকে চশমা দেব, যার ছানি পড়েছে বা অন্য কোনও সমস্যা তার সেই মতো চিকিৎসা করব। ট্যারা নির্মূল করতে অ্যামব্লায়োপিয়া থেরাপি করা হয়। একটা চোখের মণি ভিতর দিকে ঢুকে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে সেই দৃষ্টিশক্তি ফের বাড়ানোর চেষ্টা করতে চোখে প্যাচিং করা হয়। সবল চোখ ব্যান্ডেজের মতো প্যাচিং করে বন্ধ করে দিই আর দুর্বল চোখ খোলা রাখি, যাতে সেই চোখ দিয়ে বেশি করে দেখে। প্যাচিংয়ের পর দুই সপ্তাহ অন্তর তা ফলোআপ করতে হয়। কারণ প্যাচিং করতে গিয়ে চোখ খারাপের সম্ভবনা থাকলে সেক্ষেত্রে এটি এড়াতে হবে। নইলে ভাল চোখ দুর্বল হয়ে পড়বে। আগে চশমা দিয়ে দেখতে হবে দৃষ্টিশক্তির উন্নতি হচ্ছে কিনা। তারপরই অ্যামব্লায়োপিয়া থেরাপিতে যাব। তবে ১২ বছরের বেশি বয়সিদের দিয়ে লাভ নেই। এই থেরাপিতেও যদি উন্নতি না হয় সেক্ষেত্রে স্কুইন্ট সার্জারি করতে পারি। দুর্বল পেশিগুলিকে অস্ত্রোপচারে মেরামত করা হয়। সাত বছরের মধ্যে এই অস্ত্রোপচারটি করিয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। বাবা মায়েদের একটাই অনুরোধ, যখনই বুঝতে পারবেন সন্তানের চোখ ট্যারা লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন। এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। বেশি দেরি করলে দৃষ্টিশক্তি কমে অ্যামব্লায়োপিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

About The Author


Verified by MonsterInsights