জয়দীপ মৈত্র,২২শে ফেব্রুয়ারী, দক্ষিণ দিনাজপুর: দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সদর শহর বালুরঘাট হোসেনপুরের কাছে চকবাখর গ্রামে চঞ্চলা কালী মায়ের পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে জোড়কদমে। আগামী ১৫ই মার্চ শনিবার গভীর রাতে চঞ্চলা কালী মায়ের পুজো অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও বালুরঘাটে চঞ্চলা কালী মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে ১৫ই মার্চ শনিবার থেকে ১৭ই মার্চ সোমবার পর্যন্ত তিনদিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবার দোল পূর্ণিমার প্রতিপদে সাড়ে দশ হাত এই চঞ্চলা কালীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই কালীর পায়ের নীচে শিব নেই। আছে অসুর ও সিংহ। তাছাড়াও এই কালী মাতার হাত মোট আটটি। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এই পুজোয় শুধু দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ ভিনরাজ্যের ভক্তরাও উপস্থিত হন। এদিকে এই পুজো ও মেলাকে কেন্দ্র করে যাতে কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্য বিশাল পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
বালুরঘাট শহরের অদূরে ডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের হোসেনপুরের কাছে চকবাখর গ্রাম। প্রতি বছর এখানে দোলপূর্ণিমার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদের গভীর রাতে চঞ্চলা কালীর পুজো হয়। চিরাচরিত কালীর পায়ের নীচে শিবের দেখা মিললেও, এই কালীর পায়ের নীচে অসুর রয়েছে। পাশাপাশি, অন্য পায়ের নীচে আছে সিংহ। বলা হয়, মহামায়া ও চামুণ্ডার এক রূপ এই চঞ্চলা কালী মাতা। আনুমানিক ৩০০ বছর আগে ওই এলাকায় চঞ্চলা কালীর পুজো শুরু হয়। কথিত আছে, ওই মন্দির এলাকা থেকে কিছু অলৌকিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তখন মাহিনগর এলাকার মহি রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। মাহিনগর থেকে সুরঙ্গ পথে চকবাখরে এসেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এই পুজো দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে এলাকার কেরালু বর্মন নামে এক বাসিন্দা স্বপ্নাদেশ পেয়ে আবার পুজোর সূচনা করেন। এই পুজোর আর্থিক সহযোগিতা করত স্থানীয় জমিদার সুধীর চৌধুরী। প্রথমে মাটির মন্দির। তারপরে টিনের ও পরে পাকা মন্দির তৈরি হয়েছে। যদিও এখনও সেই মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে। একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত বার্ষিক পুজো করেন। প্রতি অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় চঞ্চলার পূজা অন্য একজন পুরোহিত করেন। পুজো উপলক্ষে প্রায় ৩০০ জন ভক্ত হন। প্রত্যেকে পৈতে ধারণ করেন। চঞ্চলা কালীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে শ্মশান কালী ও মাশান কালীর মন্দির।
মা চঞ্চলার পুজোর পরের দিন শ্মশান কালী ও মাশান কালী তন্ত্রমতে ভক্তিভরে পূজিত হন। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাটমন্দির, যেখানে পুজোর পরে দুদিন রাতভর মঙ্গলচন্ডীর গান শোনানো হয়। তার সামনে রয়েছে একটি পুকুর। জনশ্রুতি রয়েছে, এই পুকুর থেকে একসময় পুজোর কাজের জন্য থালা-বাসন ভেসে উঠত। বর্তমানে এই পুকুরের জল দিয়ে মায়ের পুজো করা হয়। পুজোর পাঁচ দিন আগে ঘট বসে মন্দিরে। এখানে পাঁঠা, পায়রা, চুল বলির প্রথা রয়েছে। বলির জন্য কাঠের কাতরা এই পুকুরেই বছরভর ডোবানো থাকে। পুজোর দিন বিকেলে তা তোলা হয়। তবে এই বলি শুধু কমিটির তরফ থেকেই হয়। পুজো উপলক্ষ্যে তিন দিনের মেলা বসে। ভক্তদের লোক ক্রিড়া এই পুজোর আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। একটি বড় কাঠের পাটাতনে পুঁতে রাখা পেরেক ও খর্গের উপর ভক্তরা শিব কালী সেজে নাচ করেন। বিভিন্ন লোকবাদ্য যেমন ঢাক, ঢোল, কাঁসর ব্যবহৃত হয়। লোকনৃত্যের অঙ্গ মুখা নাচ ও অস্ত্র নিয়ে খেলার রীতি রয়েছে। যা লোকসংস্কৃতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। প্রায় ২৫ জন ভক্ত এই নাচ ও খেলা দেখান।
এবিষয়ে জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের বংশধর তথা পুজো কমিটির সভাপতি সুপ্রিয় কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন – সঠিকভাবে বলা না গেলেও প্রায় তিনশো বছর আগে এই পুজোর শুভ সূচনা হয়। তবে মাঝে বেশ কিছুদিন এই পুজো বন্ধ ছিল। এলাকার কেরালু বর্মন নামে এক বাসিন্দা স্বপ্নাদেশ পেয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য এই পুজোর সূচনা করেন। দোল পূর্ণিমার প্রতিপদেই তিনশো বছরের বেশী সময় ধরে এই মা পূজিত হয়ে আসছেন। মায়ের পায়ের নীচে শিব নেই, রয়েছে অসুর। নতুন করে মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। আগামীতে ইচ্ছে রয়েছে এখানে প্রতিদিন পুজো করার পাশাপাশি এটিকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার। পুজোকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। মোট তিন দিন চলে এই পুজো ও মেলা।