গোপাল বিশ্বাস, নবদ্বীপঃ আজ নবদ্বীপের শহরের ১৬ নং ওয়ার্ডে সরকার পাড়া ‘নাস্তিক ভিলা’য় মুক্ত চিন্তক ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে স্মরণ করলো ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র নবদ্বীপ শাখা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মগ্রন্থে ‘আধুনিক বিজ্ঞানের’ সন্ধান পাওয়া যায়, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর, তার আগে নয়। কারণ বিজ্ঞানের দায় পড়েনি ধর্মগ্রন্থ থেকে দীক্ষা নিয়ে আলোর সন্ধান লাভ করতে, বরং ধর্মগুলোই জেনে গেছে, বিজ্ঞান ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না।” — এই সত্য কথাগুলি অভিজিৎ রায় তাঁর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইতে খুব সহজ সরলভাবে তুলে ধরেছেন। গত ২০১৫ সালের ২৬ শে ফ্রেব্রুয়ারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি লেখার কারণে মৌলবাদীদের হাতে খুন হন এই বিজ্ঞান লেখক ও মুক্ত চিন্তক।
মুক্ত মনের অধিকারী হওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। আমরা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে দেখেছি এবং দেখতে পাচ্ছি মুক্ত চিন্তা, কুসংস্কার, বিজ্ঞান মনষ্কতা নিয়ে কাজ করা কতোটা কঠিন। এই কাজটা যে বিপজ্জনক সেটি প্রমাণ করেছে ভারতের সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ড। অভিজিৎ রায় বা মাশাল খানের খুন যেমন একক ঘটনা নয়, তেমনই গৌরী লঙ্কেশের হত্যার আগে নিহত হয়েছেন এম কালবুর্গি, গোভিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র ধাভলকার। ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে যে কতোটা অমানুষ ও হিংস্র বানাতে পারে তা আমরা প্রায় দেখতে পাই।
অভিজিতের মৃত্যু ইতিহাসেরই অনুসরণ মাত্র। ইটালির বিজ্ঞানী ব্রুনো সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে ধর্ম বিরোধী দোষে দোষী সাবস্ত করে জনসম্মুখে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো ধর্মান্ধ খুনি মৌলবাদীরা। গ্যালিলিওকেও অসত্য ও ধর্ম বিরোধী প্রচার করার মিথ্যা অভিযোগে জেলে বন্দি করে হত্যা করেছিলো এই ধর্মান্ধ মৌলবাদীরাই। বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সমাজে প্রথিত অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে বিনাশ করে সমাজ সভ্যতাকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁদেরকেও ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়তে হয়েছিলো, অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলো, অনেককেই প্রাণ দিতে হয়েছিলো।
অভিজিৎ রায় বাংলাদেশে ‘মুক্তচিন্তা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। অভিজিৎ রায় নিজের ব্লগ মুক্তমনায় লেখালেখি ছাড়াও ১০টির মত বই লিখেছেন। বইগুলো হচ্ছে: আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান, ভালবাসা কারে কয়, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, বিশ্বাসের ভাইরাস, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে। এই সকল মুক্তচিন্তার বই প্রত্যেক মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। অনন্ত মহাবিশ্বের সংবাদ প্রচারের অপরাধে, ধর্মের অসারতা তুলে ধরার অপরাধে, সত্যকে সকলের সামনে সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করার অপরাধে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি শুধু আমাদের, ঈশ্বরবিহীন এক মহাবিশ্বের সন্ধান দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সন্ধান। তিনি আমাদের আলোর পথ দেখাতে চেয়েছিলেন।
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র নবদ্বীপ শাখার সম্পাদক প্রতাপ চন্দ্র দাস বলেন, “অভিজিৎরা কখনো মরে না, মরতে পারে না। এক অভিজিতের মৃত্যু হাজার হাজার অভিজিৎ এর জন্ম দেয় সেটা হয়তো ধর্মান্ধ খুনী মৌলবাদীরা জানেনা। কত মৃত্যু আর কত রক্তের বিনিময়ে ধর্মের এই বর্বরতা থেকে আমরা আমাদের সুস্থ সুন্দর সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারি অভিজিতের প্রয়াণ দিবসে মুক্তমনে সেই চর্চা শুরু করাটা বিশেষভাবেই প্রয়োজন। আসুন আমরাও আমাদের সমাজ সভ্যতাকে মুক্তচিন্তার আলোয়, বিজ্ঞানের আলোয়, যুক্তিবোধের আলোয় আলোকিত করে তুলি। “