জল জীবন, আবার মৃত্যুও!‌ যদি না আমরা সচেতন হই


২৫ জুলাই, শুক্রবার ওয়ার্ল্ড ড্রাউনিং প্রিভেনশন ডে

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

কলকাতা- একটি নদী, পুকুর বা জলাশয়। তার এক পাশে খেলে বেড়ানো কিছু শিশু। হাসি-ঠাট্টা, লম্ফঝম্ফ আর মাটির পাড়ে বসে চুল শুকোনো। এ যেন গ্রামবাংলার এক চিরন্তন দৃশ্য। কিন্তু কখনও কখনও এই ছবিটাই হয়ে ওঠে শোকের গল্প। সবার অলক্ষ্যে, নীরবে ঘটে যায় হৃদয়বিদারক ঘটনা। আগামী ২৫ জুলাই ওয়ার্ল্ড ড্রাউনিং প্রিভেনশন ডে বা ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস। এই দিনটি মনে করিয়ে দেয়, জলে ডুবে মৃত্যু শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ ডলে ডুবে মারা যায়। প্রতি মিনিটে একজন এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি মৃত্যু ঘটে ১৫ বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের মধ্যে। অনেকেই শিশু তাদের মধ্যে। আর এই মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি ঘটে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তার মধ্যে ভারত অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গও তারই অঙ্গ।
এই মৃত্যু একধরনের নীরব মহামারি। কোনও আওয়াজ নেই, কোনও হাহাকার নেই। শুধু থেমে যায় শ্বাসপ্রশ্বাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডুবে যাওয়া মৃত্যুর ৮০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। শুধু কয়েকটি সহজ ধাপ অনুসরণ করলেই প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। যেমন শিশুদের জন্য নিয়মিত সুরক্ষিত স্থানে নজরে রাখা, সাঁতার শেখানো বাধ্যতামূলক করা, জলাশয়ের চারপাশে ব্যারিকেড বা গার্ড রাখা, কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (‌সিপিআর)‌ বা জীবন বাঁচানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় স্তরে ক্যাম্পেন করা। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরামর্শগুলো মেনে মাঠে নেমে এই কাজের বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? কে বা কারা করবে এই কাজ? ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও এখনও পর্যন্ত ডুবে মৃত্যুর জন্য কোনও জাতীয় নীতি নেই। এই অভাবপূরণে কিছু বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠন এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সব সময় তাদের কাজকে ত্বরাণ্বিত করতে অ‌গ্রণীর ভূমিকা পালন করে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। সেটা সম্ভব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আন্তরিক উদ্যোগ ও সহমর্মী মনোভাবের জন্যই। এ রাজ্যে সিনি (‌চাইল্ড ইন নিড ইন্সটিটিউট)‌ স্বাস্থ্য দপ্তর, জেলা প্রশাসন ও পঞ্চায়েত দপ্তরের সঙ্গে মিলেমিশে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে চলেছে। কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নানা জায়গায় ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে যুদ্ধে নেমেছে। তারা বুঝেছে, এই লড়াই জলের বিরুদ্ধে নয়, এটি অসচেতনতা, অবহেলার বিরুদ্ধে। জলে ডুবে প্রতিরোধ দিবস নিয়ে সিনির উদ্যোগে গোটা রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রবিবার দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুলতলিতে একটি পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। সচেতনতামূলক আলোচনা, নাটক হয়। সোমবার থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরে শুরু হচ্ছে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি। যা সারা মাস ধরেই চলবে।

 

সিনির ন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি অফিসার সুজয় রায় বলেন,‘ডুবে যাওয়া নীরব ঘাতক, যা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। সকলে মিলে যৌথভাবে সামান্য একটু চেষ্টা করলেই প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু আমরা আটকাতে পারব। এই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য ‌সংস্থার থিম ‘‌ইওর স্টোরি ক্যান সেভ অ্যা লাইফ’‌ অর্থাৎ ‘‌আপনার গল্প বাঁচাতে পারে একটি প্রাণ’‌। এটিকে মাথায় রেখে রাজ্যব্যাপী ৭৫টি স্থানে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। যেখানে সচেতনতামূলক বার্তা দিয়ে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে পদযাত্রা, আলোচনাসভা, পথ নাটিকা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকছে। রাজ্য স্তরের মূল অনুষ্ঠান হবে কলকাতার রোটারি সদনে। যেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলারা কিভাবে সিপির প্রশিক্ষণ নিয়ে শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন শোনাবেন সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী। জল জীবন দেয়, তাই সে জীবন নেবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।’‌
দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা সহ বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত চলছে সচেতনতা শিবির। শিশুদের শেখানো হচ্ছে জলাশয় থেকে কীভাবে নিরাপদে থাকতে হয়। মায়েদের সিপিআর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, কীভাবে শিশুদের নজরদারি করতে হবে বোঝানো হয়। মাইকে প্রচার, এমনকি পাড়ার ক্লাব, গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে মিলে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কাজ চলছে। যার জন্য ভারতের মধ্যে প্রথম পুকুর ভিত্তিক সুইমিং পুলও তৈরি করেছে সিনি। অনেক পুকুরের আশেপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়েছে। শিশুদের রাখার জন্য নির্দিষ্ট ‘সেফ জোন’ বা ‘‌কবচ’‌ তৈরি করা হয়েছে। এই কাজগুলি বড় নয়, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে একটি করে হলেও জীবন বাঁচছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দেশে বহু শিশু সাঁতার না জানার কারণে ডুবে মারা যায়। বিশেষ করে কন্যাশিশুরা, যাদের বহুক্ষেত্রে সামাজিকভাবে সাঁতার শেখার অনুমতি দেওয়া হয় না। সিনি সহ বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারকে এ বিষয়ে নীতিগত পদক্ষেপ করার জন্য একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে। আজ যখন শহরবাসী মোবাইল অ্যাপ বেসড লাইফস্টাইলে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, তখন গ্রামে, মফস্বলে, প্রায় প্রতিদিন একটি না একটি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে কেবল অসচেতনতায়। কিন্তু এটা রোখা সম্ভব। শিশুদের সাঁতার শেখানো, পর্যাপ্ত নজরদারি, জলাশয় ঘেরা ও জীবনদায়ী কৌশল (‌সিপিআর)‌ শেখানো —এই চারটি জিনিস যদি পরিবার, পাড়া ও প্রশাসন স্তরে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে অনেক মৃত্যুকে ঠেকানো সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাঁতার শেখানোকে প্রাথমিক শিক্ষার অংশ করলে, স্কুলে সিপিআর শেখানো বাধ্যতামূলক করলে ডুবে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। একটি শিশু ডুবে যাওয়ার আগে কোনও শব্দ উচ্চারণ করে না। তাই আমাদের কানে কোনও চিৎকার পৌঁছায় না। কিন্তু তার মা-বাবার মনে সারাজীবন সেই নীরবতা গর্জন করে চলে। তাই ২৫ জুলাইয়ের আগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া দরকার, ‘জলের নাম জীবন, তা যেন মৃত্যু ডেকে না আনে।’

About The Author


Verified by MonsterInsights