বিষয়: বাংলা চলচ্চিত্রে মহানায়ক উত্তমকুমারের অবদান –
কলমে: সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য্য
একজনের পার্সোনালিটি থেকেও কারুর কাজ যখন বেশি আলোচিত হয়- তখন খেতাবই আসল উপাধি। এমনটাই হয়েছে উত্তম কুমারের ক্ষেত্রেও। সাধারণ এক অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘উত্তম’ হওয়ার গল্প আরেকবার তার প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে পাঠকের জন্য মালায় গাঁথলেন সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য্য |
বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী অভিনেতা মহানায়ক উত্তম কুমার। সদা মায়াময় হাসি এবং রোমান্টিক ও প্রাণবন্ত অভিনয়ের এই জাদুকর বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ‘মহানায়ক’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি একাধারে ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও উত্তম কুমার সফলভাবে মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন।
আজ ২৪ জুলাই মহানায়ক উত্তম কুমারের ৩৮তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৮০ সালের শুটিংরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। অগণিত বাঙালির মনে স্বপ্নের নায়ক হয়ে চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন বিস্ময়কর এই অভিনয় প্রতিভা।
১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং চপলা দেবীর ছোট্ট সংসারে জন্ম নেয় অরুণ। সেই অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ই পরবর্তীতে বাংলার সিনেপর্দা কাঁপিয়ে হয়ে ওঠেন মহানায়ক উত্তম কুমার। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ১৯৪২ সালে কলকাতার সাউথ সাবারবান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর গোয়েন্কা কলেজে ভর্তি হন তিনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। সংসারে আর্থিক অনটনের জন্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই তাকে ছুটতে হয় চাকরির সন্ধানে।
কলকাতা পোর্টে মাত্র ২৭৫ টাকা মাইনাতে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই যাত্রা-থিয়েটারে তার ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। ১৯৩৬ সালে চক্রবেড়িয়া স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গয়াসুরের ভূমিকায় অভিনয় করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ছোট্ট অরুণ। সেই থেকে রূপালী পর্দায় কাজ করার স্বপ্ন -মনে লালন করতে থাকেন তিনি। অচিরেই মিলে গেল সেই সুযোগটি। ১৯৪৭ সালে তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায় ভোলানাথ আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামক হিন্দি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। প্রথম দিকে দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিকে পাঁচদিন কাজ করেন। তবে উত্তম কুমারের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল ‘দৃষ্টিদান’।
১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপর একে একে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেও সাফল্য না পেয়ে সিনেমাপাড়ায় তার নাম বনে যায় ফ্লপমাস্টার। কে জানতো এই ফ্লপমাস্টারই হয়ে উঠবেন বাংলার মহানায়ক। তখন সিনেমার রোজগারে সংসার চালানো সম্ভব হয়ে উঠছিলো না। তাই অভিনয়ের পাশাপাশি চাকরিও চালিয়ে যান। ১৯৪৮ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করেন গৌরি গাঙ্গুলিকে।
নায়ক চরিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ১৯৪৯-এ ‘কামনা’ ছবিতে উত্তম চট্টোপাধ্যায় নামে এবং ১৯৫১ সালে উত্তম কুমার নামে অভিনয় শুরু করেন ‘সহযাত্রী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ঠিক ঐ বছরই জন্ম নেয় তার একমাত্র পুত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায়। জনপ্রিয়তার খাতিরে পাহাড়ি স্যান্নাল তার নাম বদলে রাখেন উত্তম কুমার। সব ছেড়ে সিনেমায় মন দেবেন বলে মনস্থির করেন উত্তম। অবশেষে ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে কাজ করে অভাবনীয় সাফল্য পান উত্তম কুমার। সেই সাথে বাংলা চলচ্চিত্র পায় অভিনয় জগতের এক নতুন নক্ষত্র। “বসু পরিবার” ছিল তার প্রথম হিট ছবি। এই ছবির সাফল্যের পর চাকরি ছেড়ে তখন পুরোপুরি অভিনয়ে নেমে পড়েন উত্তম। সময়ের সাথে সাথে ঝলসে ওঠেন উত্তম কুমার।
তার পরের বছর ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে-চুয়াত্তর’ মুক্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ইতিহাস রচনা শুরু হয়। কেননা, এ ছবির মাধ্যমেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। শুরু হয় কিংবদন্তী এই জুটির একসাথে পথচলা; সাথে রচিত হতে থাকে উত্তম কুমার নায়ক থেকে মহানায়ক হওয়ার অনন্য অধ্যায়। ১৯৫৪-এ জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিল উত্তম-সুচিত্রার ‘অগ্নিপরীক্ষা’। ষাটের দশক পুরোপুরিভাবে অসাধারণ প্রশংসিত বেশ কিছু ছবি উপহার দিয়ে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে মাতিয়েছেন উত্তম-সুচিত্রা। যার মধ্যে ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’ এবং ‘সাগরিকা’সহ অনেক ছবিতে তাদের জীবন্ত-প্রাণবন্ত অভিনয়গুণে ‘রোমান্টিক’ জুটির শীর্ষস্থানে পৌঁছে যান উত্তম-সুচিত্রা। যা আজও বাঙালির কাছে একইভাবে জনপ্রিয়।
উত্তম কুমার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে- ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম। রোমান্টিক নায়ক ছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে তার সুঅভিনয় ছিল বিস্ময়কর। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটির নাম ‘নায়ক’ এবং দ্বিতীয়টি ‘চিড়িয়াখানা’। ‘চিড়িয়াখানা’ চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৫৬ সালে ‘নবজন্ম’ ছবিতে নিজের কণ্ঠে প্রথম গান গেয়ে নতুন চমক সৃষ্টি করেন উত্তম। ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ ছবিতে অভিনয় করে সমগ্র ভারতজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সে বছর ‘হারানো সুর’ পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। এরপর ১৯৫৭-এ বাংলা ভাষার প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ছবি ‘পথে হলো দেরী’তে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে করেন আরেকটি রেকর্ড।
১৯৬০ সালের দিকে সাফল্য পায় উত্তম- সুপ্রিয়ার ‘শুন বনোরাণী’ সিনেমা। সুপ্রিয়া দেবী তখন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির ধর্মপত্নী। বিয়ের পর সুপ্রিয়াকে বাধ্য করা হয় অভিনয় ছাড়ার জন্য। তিনি বেশ কিছুকাল পর্দার আড়ালেই কাটান। স্বামীর সাথে ডিভোর্সের পর তিনি আবার রূপালী পর্দায় ফিরে আসেন। তখন থেকে উত্তম কুমারের সাথে বন্ধুত্ব এবং ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। দুজনের ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় প্রেম।
১৯৬৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পৈতৃক বাসভবন ছেড়ে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের বাকি সময় তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সাথেই কাটান। গৌরি দেবীর সাথে আইনত ডিভোর্স না হওয়ায় রেজিস্ট্রি করতে পারেননি সুপ্রিয়া দেবীকে। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবীর ভাষ্যমতে, ১৯৬২ সালের ২রা ডিসেম্বর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় বিয়ে হয় তাদের।
১৯৬৭ সালে ‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল ‘ভরত’) পেয়েছিলেন উত্তম কুমার। এছাড়া তিনি নিউইয়র্ক, বার্লিন চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবে অতিথি হওয়ার সম্মানও অর্জন করেছিলেন। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্মৃকৃতিসরূপ তিনি পেয়েছিলেন বহু পুরস্কার সম্মান না। পরবর্তীতে উত্তম কুমারের শ্রদ্ধার্ঘ্যে কলকাতা মেট্রো টালিগঞ্জ অঞ্চলের স্টেশনটির নামকরণ করা হয় ‘মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন’।
উত্তম কুমার পরিচালক হিসেবেও ছিলেন সফল। ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ (১৯৮১), ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (১৯৭৩) এবং ‘শুধু একটি বছর’ (১৯৬৬) ছবির সাফল্য তারই প্রমাণ। কর্মজীবনে সফল এই অভিনেতার ব্যক্তিজীবন অতোটা কোমল ছিল না। তার খ্যাতির সাথে সাথে লোকমুখে গুঞ্জন এবং রটনাও বাড়তে থাকে উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে। এমনি পরিস্থিতিতে স্ত্রী গৌরি দেবী তার অভিনয়ে আপত্তি না করলেও উত্তম-সুচিত্রার মেলামেশায় আপত্তি জানান, যার ফলে বাড়তে থাকে তাদের দূরত্ব। একটা সময় অভিনয়ও ছাড়তে বলেন গৌরি। কিন্তু উত্তমের পক্ষে সম্ভব হয়নি রক্তে মেশা অভিনয়ের নেশা ছাড়া।
সত্যজিৎকেও নাকি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন উত্তম?
একজন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক, অন্যজন ভারতবর্ষের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পরিচালকদের একজন। দুজনে একসঙ্গে কাজও করেছেন। অথচ সত্যজিৎ রায় নাকি একবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল স্বয়ং অরুণ কুমার চ্যাটার্জি তথা উত্তম কুমারের কাছ থেকে!
মহানায়ক উত্তম কুমার নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ৩০ বছরের বর্ণিল ক্যারিয়ারে উত্তম কুমার পর্দায় হাজির হয়েছিল ২১১টি চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে কয়েকটি আবার তার মৃত্যুর পরও মুক্তি পেয়েছিল। অপরদিকে বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নির্মাতার খেতাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে সত্যজিৎ রায়ের দখলে। কিন্তু টালিগঞ্জে একটি গুজব চাউর আছে, সত্যজিৎ রায় নাকি একবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল স্বয়ং অরুণ কুমার চ্যাটার্জি তথা উত্তম কুমারের কাছ থেকে!
কথিত আছে, ১৯৫৬ সালের শুরুর দিকে সত্যজিৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং বেশ কিছুদিন তাকে গৃহবন্দি থাকতে হয়। ওই সময়ই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’ অবলম্বনে একটি ছবি নির্মাণের চিন্তা করেন। সে অনুযায়ী চিত্রনাট্যও তৈরি করে ফেলেন। তার ইচ্ছা ছিল উত্তম কুমার সন্দীপের ভূমিকায় অভিনয় করবেন।
কিন্তু উত্তম নাকি বিনয়ের সাথে সত্যজিতের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা ইতোমধ্যেই ‘সাড়ে ৭৪’ (১৯৫৩), ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪), ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫)-এর মতো বক্স অফিস হিট ছবিতে কাজ করে উত্তম নিজের একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এরকম সময়ে সন্দীপের মতো একটি নেতিবাচক চরিত্রে কাজ করলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, একের পর এক রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে অভিনয় করে যখন উত্তম ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, ওদিকে বিচিত্র সব বিষয়বস্তুর উপর ছবি নির্মাণ করে ক্রমশই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন সত্যজিৎ, তখন কিন্তু আবার উত্তম নিজে থেকেই চেয়েছিলেন সত্যজিতের সাথে কাজ করতে। তাই তো একবার সত্যজিতের এক সহকারীকে তিনি বলেছিলেন, “মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়) বলিস রে! চাকরের রোল দিলেও আমি করব। এইসব কাজ আর ভাল লাগছে না!”
১৯৬৬ সালে প্রথম সত্যজিতের সাথে কাজের সুযোগ হয় উত্তমের। মূলত ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য সত্যজিৎ লিখেছিলেন উত্তম কুমারের কথা ভেবেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয়-পাগল যুবক ছবিতে নেমে তরতরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই অবস্থায় এই যুবকের মনে কী ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, তার মূল্যবোধে কী পরিবর্তন হতে পারে, এ-ই ছিল গল্পের বিষয়।
চিত্রনাট্য শুনে খুবই খুশি হয়েছিলেন উত্তম। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কাহিনির সাদৃশ্য। সত্যজিতের ভাষ্যমতে, গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে না চাইলেও, বা না পারলেও, তার চরিত্রটি কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে সেটি উত্তম মোটামুটি বুঝে নিতে পেরেছিলেন চিত্রনাট্য পড়েই। পাশাপাশি এটি যে গতানুগতিক প্রেমের গল্প নয়, বরং এখানে প্রেমের উপস্থিতি খুবই প্রচ্ছন্ন, আর নায়কের মাঝে দোষ-গুণ উভয়ই বিদ্যমান, এসব বাস্তবতাও উত্তম নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়েছিলেন।
ফলে সত্যজিতের নির্মাণে, উত্তমের অসাধারণ অভিনয়ে ‘নায়ক’ শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটি মাস্টারপিস। অনেকেরই বিশ্বাস, উত্তমের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া চলচ্চিত্র ছিল এই ‘নায়ক’। নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবান্বিত উত্তম, সত্যজিতের ছবিতে একটি ভিন্নধারার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই তার প্রায় সব নিন্দুক-সমালোচকদের মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উত্তমের সাথে কাজ করে দারুণ সন্তুষ্ট ছিলেন সত্যজিতও। ১৯৮০ সালে উত্তমের মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, “এটা বলতে পারি যে— উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রোফেশনাল। রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তার অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হত সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তার অভিনয়ে যোগ করত যেগুলি সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনই বাড়াবাড়ির পর্যায় পড়ত না; এটা সব সময়েই হত আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি। বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এখানেই।”
উত্তমের সাথে এরপর আরো একটি ছবিতে কাজ করেছিলেন সত্যজিৎ। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭) ছবির মাধ্যমেই প্রথম পর্দায় হাজির করেছিলেন তিনি। আর সেখানে ব্যোমকেশ রূপে ছিলেন উত্তম। এই ছবির শুটিং চলাকালীন একবার হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন উত্তম। তারপরও এই ছবি, সেই সাথে ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’ (১৯৬৭)-এর জন্য সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার খেতাব জিতেছিলেন তিনি। আর সত্যজিতও ‘চিড়িয়াখানা’-র সুবাদে হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক।
অর্থাৎ উত্তমের জীবনের সেরা দুইটি কাজের সাথেই ছিল সত্যজিতের সংযোগ। তাই তো উত্তমের ব্যাপারে সত্যজিতের নির্মোহ মূল্যায়ন, “শিল্পীর বিচার সবসময়ই হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের উপর। উত্তমের অভিনয়ের পরিধি যে খুব বিস্তৃত ছিল তা নয়, কিন্তু তার এই নিজস্ব পরিধিতে ক্রমান্বয়ে ত্রিশ বছর ধরে সে যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেল, তার তুলনা নেই। তার অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?”
(উত্তমকুমার সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিচারণ|একটি বিশেষ ইন্টারভিউতে যা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়, তা তুলে ধরা হলো)
একটা মানুষকে চেনার অনেকগুলো স্তর আছে, বিশেষ করে উত্তমের মতো একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে। যে সমস্ত দর্শকবৃন্দ তাঁর ভক্ত ছিল, তাঁরা অনেকেই হয়তো তাঁকে কনোদিন সামনে থেকে দেখেনি, তাঁরা হয়তো এখানকার লোকই নয়। কিন্তু, তাঁরাও উত্তমকে একভাবে চিনত। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে, তাঁর সম্বন্ধে পড়ে, তাঁর বিষয় জেনে তারা উত্তমকে ভীষন আপন লোক বলেই মনে করত। তাছাড়া তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, তাঁর আত্মীয়… তাদের চেনার আবার আরেকটা স্তর আছে। তারপর যাঁরা উত্তমের সাথে কাজ করেছেন, অভিনেতা-অভিনেত্রী-কলাকুশলী… তাঁদের চেনার স্তর আবার আলাদা। এই সমস্ত স্তর মিলিয়েই উত্তমের পরিচয়।
আমি তাঁকে প্রথমে চিনি দর্শক হিসাবে। তাঁর ছবি আমি দেখেছি, তাঁর সমালোচনা করেছি। এখন, এখানে কাজের কথা বলার আগে আমি স্টার কথাটা নিয়ে সামান্য দু’কথা বলতে চাই। এখানে স্টার কথাটা কখনও ছিল না, স্টার শব্দটা এসেছে হলিউড থেকে, হলিউডের অর্থে স্টার শব্দটির মানে- দর্শকদের মনের একটা বিশেষ জায়গা অধিকার করে কতৃত্ব করা। কিন্তু, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উত্তম ছাড়া আর কেউ পারেনি। পুরুষদের মধ্যে তাঁকে একমাত্র সত্যিকারের স্টার বলা যেতে পারে। আমি যখন প্রথম ঘোষনা করেছিলাম যে, আমি উত্তমকুমারকে নিয়ে একটা ছবি করছি, তখন স্টার সম্বন্ধে অনেকের মনে অনেক রকম ধারণা প্রকাশ পেয়েছিল।
আমার কানে এসেছিল; শুধু কানে কেন… চোখেও এসেছিল, কিছু কিছু পত্রিকায় কিছু কিছু ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন, “সত্যজিৎ বাবু এবার কম্প্রোমাইজ করলেন।” এতদিন করেননি, এখন করলেন। মানেটা যেন; আমি যতদিন নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করেছি, অচেনা-আনকোরা, নতুন আমেচারদের নিয়ে কাজ করেছি সেটা কম্প্রোমাইজ নয়। তারপর আস্তে আস্তে যখন পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করেছি, তখনও সেটা কম্প্রোমাইজ নয় কিন্তু, যখন আমি স্টার নিয়ে কাজ করছি সেটা হয়ে গেল কম্প্রোমাইজ। বলা হতে লাগল- সত্যজিৎ বাবু পথে এসেছেন; এবার উত্তমকুমারকে নিয়ে কাজ করছেন।
এ ধরনের ধারণাটা প্রচারিত হয় একদল লোকের মধ্যে দিয়ে যাঁরা নিজেদের হাই-ইন্টেলেকচুয়াল, বিদগ্ধ, উন্নাসিক বলে মনে করেন। কিন্তু, আমি তাদের ভাবি “বোকা”। তারা বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ তাদের স্টার সম্বন্ধে ধারণাটা এক্কেবারে অস্পষ্ট। তাদের ধারণা হ’ল যে, স্টার অভিনেতা নয় বরং তারা আরো একটা কিছু। অন্য একটা কিছু যাদের সঙ্গে শিল্পের কোনোও সম্পর্ক নেই। এখানে তাদের ধারণাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় তাও নয়, কিছু কিছু উদাহরণ আছে যা আমি নিজেই জানি। হলিউডের কথাই বলি। একজন বিশেষ স্টার বহুদিন ধরেই ছবি করছেন এবং স্টার হিসাবেই করছেন, গ্রেগরী পেক। তিনি যখন প্রথম ছবিতে নামলেন, প্রথম ছবির শ্যুটিং করছেন, তখন পরিচালক এবং প্রযোজক তাঁর সঙ্গে কাজ করে বুঝতে পারলেন একে দিয়ে আর হবে না।
ll সাক্ষাৎ সত্যজিৎ ll
এই ছবির পরেই একে বাতিল করতে হবে… ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, ছবি যখন মুক্তি পেল তার অল্প দিনের মধ্যেই এত লক্ষ লক্ষ ফ্যান মেল গ্রেগরী পেকের নামে এল যে প্রযোজককে বাধ্য হয়েই গ্রেগরী পেককে স্টারের মর্যাদা দিয়ে স্টার হিসাবে রেখে দিতে হল এবং তিনি এখনও স্টার হিসাবে রয়ে গেছেন। যদিও আমি শুনেছি তাঁকে দিয়ে সঠিক কাজটা করিয়ে নেওয়া বেশ দুরূহ ব্যাপার। তিনি স্টার হয়ে গিয়েছিলেন ঘটনাচক্রে, কারণ পর্দার দর্শকরা তাঁর কাছ থেকে এমন কিছু পেয়েছিল যা তাদের ভয়ানক ভালো লেগেছিল। আবার, এর বিপরীত নিদর্শনে রয়েছেন মারলান ব্রান্ডো। যিনি থিয়েটারে অভিনয় করে নাম করেছিলেন এবং নামী থিয়েটার অভিনেতা হিসাবে হলিউডে আসেন এবং প্রথম ছবিতে অভিনয় করেই স্টার হয়ে যান। তাঁকে নিয়ে কোনো প্রযোজক পরিচালককে কোনো দিন অসুবিধা ভোগ করতে হয়নি। কারণ, তিনি অতি উঁচু দরের অভিনেতা ছিলেন। তাঁর কাহিনী কিছুটা অন্যরকম।

উত্তমকুমারের প্রথম দিকের ছবির কথা আমি যানি না, তাঁর সেই সব ছবির নামও আমি বলতে পারব না। তিনি অল্প বয়সে অভিনয় এসেছিলেন এবং তিনি তখন খুব ভালো অভিনয় করতে পারতেন কিনা সে বিষয় আমার সন্দেহ আছে। তাঁর সে সব অভিনয় লোকে নেয়নি, লোকে ভুলে গেছে এবং উত্তমকুমারকে স্টার হওয়ার জন্য যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। আমি যখন প্রথম তাঁর ছবি দেখি তখন তিনি কিছুটা নাম করে ফেলেছেন। পরিচালক নির্মল দে’-র বসু পরিবার, সাড়ে চুয়াত্তর, চাঁপাডাঙার বৌ এই তিনটে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল যে এই পরিচালক বেশ চতুর ও দক্ষ। উত্তমকুমারকে আমার ভালো লেগেছিল কারণ তাঁর মধ্যে একটা সাবলীলতা ছিল, একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। যেখানে একজন পরিচালক অভিনেতাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন সেখানে ভালো অভিনয় দেখে দর্শকরা কখনও জানতে পারবেন না যে অভিনয়টা কোথা থেকে এসেছে। অভিনেতার মধ্যে থেকে? না অভিনয়ের অনেকটা পরিচালকের অবদান।
তখনও আমি ছবির জগতে আসিনি। তার তিন-চার বছর পর আমি ছবি নির্মাণে হাত দিই, তারও দশ-বারো বছর পর আমি উত্তমের সাথে কাজ করেছি এবং এর মধ্যে আমি উত্তমকুমারের আরো কয়েকটা ছবি দেখেছি। উত্তম তখন ক্রমে ক্রমে রোমান্টিক স্টারের পর্যায় উঠেছেন এবং তাঁর যে অভিনয় ক্ষমতা আছে সেটা আমি বুঝি কিছু ছবির অভিনয় দেখে। যেখানে আমি বুঝতে পারছি যে পরিচালক খুব সুবিধার কাজ জানেন না বা তেমন ভাবে দক্ষ নন সেইখানে কিন্তু উত্তমের কাজ দেখে আমাকে স্বীকার করতে হয়েছে… আমি বুঝতে পেরেছি যে, এই ছেলেটির মধ্যে জিনিস আছে। যেখানে পরিচালক তাঁকে খুব একটা সাহায্য করতে পারছেন না বা সাহায্য করার ক্ষমতাপ পরিচালকেরনেই, সেখানে আমাকে ধরে নিতেই হবে যে অভিনয়ের অনেকটাই উত্তমকুমারের নিজের অবদান এবং উত্তমকুমার তাঁর অঙ্গভঙ্গি চলনবলনের মাধ্যমে নিজের একটা ইমেজ তৈরী করে নিয়েছেন।
উত্তম জানতেন যে কতটা করলে বা পর্দায় দেখলে দর্শক পছন্দ করবে বা দর্শক তারিফ করবে… এটা উত্তম বুঝে নিয়েছিলেন। এটা একটা সাংঘাতিক গুনের কথা, এটা সহজে হয় না। একজন স্টার হিসাবে উঠে আসতে গেলে কতকগুলো গুণ রপ্ত করতে হয়… যে, আমাকে এভাবে চলতে হবে, এভাবে বলতে হবে, এইখানে থামতে হবে ইত্যাদি। এবং আমার মনে হয়েছিল উত্তমকুমার নিশ্চয়ই স্টার তবে অভিনেতাও বটে এবং আমি ভেবেছিলাম এর সাথে কাজ করেই দেখা যাক না।
মহানায়ক হয়ে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই মৃত্যুবরণ করেন বাঙালির এই সিনেনক্ষত্র। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের মহানায়ক। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই তার অভিনীত ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমার শুটিংরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন উত্তম কুমার। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টায় কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ভুবনভোলানো হাসিমাখা এই মহান অভিনেতা সবাইকে কাঁদিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার অনবদ্য অভিনয় দেখলে কখনো মনেই হয় না- তিনি আমাদের মাঝে নেই। মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা কিংবদন্তী এই মহানায়ক মাত্র ৩২ বছরের অভিণয় কেরিয়ারে আমাদের যা দিয়ে গেছেন তা অতুলনীয়। সৃষ্টিশীল মানুষ চলে গেলেও ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকেন। উত্তম কুমার যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, সেটি বাঙালির অন্তর জুড়ে অমলিন থাকবে যুগ থেকে যুগান্তর।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!
তথ্যসূত্র :-
আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ
“Of fond memories”, The Telegraph, 24 July 2003, retrieved 15 August2010
Dasgupta, Priyanka (24 July 2010), “Star struck for Uttam?”, The Times of India, retrieved 15 August 2010
“Byomkesh Bakshi”, The Telegraph, 7 August 2010, retrieved 15 August2010
“Uttam Kumar: As a Producer”, gomolo, 13 June 2008, retrieved 4 September 2011
Nag, Kushali (20 July 2008), “Living with Uttam Kumar”, The Telegraph, retrieved 15 August 2010
“Reference: Two Legends and Their Lives: Uttam Kumar Suchitra Sen”. Learning and Creativity. 13 September 2012. Retrieved 27 January 2014.
“Beyond the Enigma: Uttam Kumar, the Man and the Mahanayak”. The Quint. 3 September 2017.
Das, Mohua (9 December 2009), “how Saptapadi shattered stereotypes”, The Telegraph, retrieved 15 August 2010
Nag, Kushali; Chattopadhyaya, Sanjoy (16 December 2008), “Saptapadi bike still road-worthy”, The Telegraph, retrieved 15 August 2010
Websites store cookies to enhance functionality and personalise your experience. You can manage your preferences, but blocking some cookies may impact site performance and services.
Essential cookies enable basic functions and are necessary for the proper function of the website.
Name
Description
Duration
Cookie Preferences
This cookie is used to store the user's cookie consent preferences.
30 days
These cookies are needed for adding comments on this website.
Name
Description
Duration
comment_author
Used to track the user across multiple sessions.
Session
comment_author_email
Used to track the user across multiple sessions.
Session
comment_author_url
Used to track the user across multiple sessions.
Session
Google Tag Manager simplifies the management of marketing tags on your website without code changes.
Name
Description
Duration
cookiePreferences
Registers cookie preferences of a user
2 years
td
Registers statistical data on users' behaviour on the website. Used for internal analytics by the website operator.
session
Statistics cookies collect information anonymously. This information helps us understand how visitors use our website.
Google Analytics is a powerful tool that tracks and analyzes website traffic for informed marketing decisions.
Contains information related to marketing campaigns of the user. These are shared with Google AdWords / Google Ads when the Google Ads and Google Analytics accounts are linked together.
90 days
__utma
ID used to identify users and sessions
2 years after last activity
__utmt
Used to monitor number of Google Analytics server requests
10 minutes
__utmb
Used to distinguish new sessions and visits. This cookie is set when the GA.js javascript library is loaded and there is no existing __utmb cookie. The cookie is updated every time data is sent to the Google Analytics server.
30 minutes after last activity
__utmc
Used only with old Urchin versions of Google Analytics and not with GA.js. Was used to distinguish between new sessions and visits at the end of a session.
End of session (browser)
__utmz
Contains information about the traffic source or campaign that directed user to the website. The cookie is set when the GA.js javascript is loaded and updated when data is sent to the Google Anaytics server
6 months after last activity
__utmv
Contains custom information set by the web developer via the _setCustomVar method in Google Analytics. This cookie is updated every time new data is sent to the Google Analytics server.
2 years after last activity
__utmx
Used to determine whether a user is included in an A / B or Multivariate test.
18 months
_ga
ID used to identify users
2 years
_gali
Used by Google Analytics to determine which links on a page are being clicked
30 seconds
_ga_
ID used to identify users
2 years
_gid
ID used to identify users for 24 hours after last activity
24 hours
_gat
Used to monitor number of Google Analytics server requests when using Google Tag Manager