a6da8739-b921-4d31-926a-ee021b56e17c

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বালুরঘাটের হোসেনপুরে আত্রেয়ী নদীর খাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় জমিদার স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চৌধুরীর পরিবারের ডাকরাচন্ডী দুর্গা মাতার পুজো। এই পুজো তিনশো উননব্বই বছরের প্রাচীন। এই ডাকরাচন্ডী দুর্গা মাতার পুজো দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাবাসীর কাছে স্থানীয় এলাকার জমিদার স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চৌধুরীর পুজো নামে পরিচিত। এই পুজোকে ঘিরে ভক্তদের মুখে বহু অলৌকিক ঘটনা শোনা যায়। বালুরঘাটের হোসেনপুরে ডাকরাচন্ডী দুর্গা মণ্ডপের এলাকাটি আগে বালুরঘাটের ডাকরা মৌজার অন্তর্গত ছিল, ডাকরা মৌজার নামানুসারেই ভক্তদের মাধ্যমে এই দুর্গা মণ্ডপ ডাকরাচন্ডী দুর্গা মণ্ডপ নামে পরিচিতি লাভ করে। স্থানীয় এলাকার জমিদার স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চৌধুরীর বংশধর সুপ্রিয় কুমার চৌধুরীর কাছ থেকে জানাগেছে – দশ পুরুষ ধরে এই পুজো হয়ে আসছে, আজ থেকে বহুবছর আগে ডাকরাচন্ডী দুর্গা মণ্ডপ এলাকার পাশে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়েই আত্রেয়ী নদীর মূল স্রোত ধারা বয়ে যেত। সেখানেই পঞ্চবটী বন ছিল। ওই পঞ্চবটী বনেই ঋষিরা ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে পঞ্চমুন্ডীর আসন স্থাপন করে মা দুর্গার পুজো করতেন, কিন্তু পরবর্তীকালে ঋষিদের অবর্তমানে এই পুজো বন্ধ হয়ে যায়, তারপর ওই পঞ্চমুন্ডীর আসনটি যুগ যুগ ধরে খোলা আকাশের নিচে অযত্নে ও অবহেলায় পরে থাকার পর কালক্রমে মাটির তলায় চলে যায়, জমিদার স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চৌধুরীর পূর্বপুরুষ রামচন্দ্র মন্ডলকে এরপর মা দুর্গা স্বপ্নাদেশে ওই পঞ্চমুন্ডীর আসনটিকে মাটির তলা থেকে উদ্ধার করে পুনরায় পুজো শুরু করার বিধান দেয়, স্বপ্নাদেশ পাওয়ার ঠিক পরের দিন সকালে মাটি খুঁড়ে ওই পঞ্চমুন্ডীর আসনটি উদ্ধারের পর ঘটা করে ধুমধাম সহকারে দুর্গা পুজো শুরু করেন। কালক্রমে ওই এলাকায় আত্রেয়ী নদীর মূল স্রোত ধারার গতিপথ পরিবর্তন করলে খাঁড়িতে রূপান্তরিত হয়। প্রথম দিকে এই পুজোতে মৃৎশিল্পী, পুরোহিত, পুজোর জোগাড়ী, পুজোর ভোগ রান্নার ঠাকুর ও ঢাকী সবকিছুই বংশানুক্রমিক ভাবে হতো কিন্তু বর্তমানে আর বংশানুক্রমিক ভাবে হয় না। জমিদার সুধীর চন্দ্র চৌধুরীর পিতা জমিদার শশীভূষণ মন্ডলকে ব্রিটিশরা চৌধুরী উপাধি প্রদান করেন। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী জন্মাষ্টমী পুজোর দিন কাঠামো শুভক্ষণের মাধ্যমে প্রতিমা তৈরীর কাজ শুরু হয়, প্রতিবছর নতুন কাঠামোতে মায়ের প্রতিমা তৈরী হয়। প্রথম থেকেই এই পুজোতে এক কাঠামোতে ডাকের সাজে মা দুর্গা তার স্বপরিবারে পুজো পেয়ে আসছে। পুজো শুরু হওয়া থেকেই মহাষষ্ঠীর দিনই মাকে রঙের পর চক্ষুদান করে সাজানো হয়। মায়ের প্রতিমাতে সাজানোর সময় প্রচলিত রীতিনীতি অনুসারে কোনরকম পেরেকের ব্যবহার না করে আঠা দিয়ে করা হয়। পুজোতে কোন পাঁঠা বলি হয় না। এই পুজোর মূল বিশেষত্ব হলো পুজোর দিনগুলোতে দিনের বেলায় মাকে নাড়ু, মুড়কি, মোয়া, ফল, বাতাসা ও মিষ্টি দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় এবং রাতের বেলায় অন্ন ভোগ দেওয়া হয়। মহাসপ্তমীর দিন রাতে অন্ন ভোগের সঙ্গে সাত রকম ভাজা, লাবড়া ঘাঁটির তরকারি, লুচি, পরমান্ন, পায়েস ও মিষ্টান্ন দিয়ে মাকে ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়াও মহাষ্টমীর দিন রাতে অন্ন ভোগের সঙ্গে আট রকম ভাজা ও মহানবমীর দিন রাতে অন্ন ভোগের সঙ্গে নয় রকম ভাজা মাকে ভোগ দেওয়া হয়। ভক্তদের কাছে এই মা সদা জাগ্রত। মায়ের কাছে ভক্তি ভরে কোন কিছু চাইলে মা তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেন। সেই কারণে পুজোর দিনগুলোতে বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তদের এসে মাকে পুজো দিতে দেখা যায়। মহাষ্টমীর দিন সকালে বহু মানুষ এই মন্ডপে পুষ্পাঞ্জলি দেয়। প্রতিবছর মহানবমীর দিন চৌধুরী বাড়ির পক্ষ থেকে বহু মানুষকে মায়ের মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমী পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি মন্ডপে মঙ্গলচন্ডী পালা গান হয়। মহানবমীর দিন সন্ধ্যারতির পরে মায়ের চরণ থেকে ফুল পড়ার দৃশ্য দেখতে বহু ভক্ত উপস্থিত হয়। দশমীর দিন সকালে আগুন নাচ ও চামুণ্ডার মুখা নৃত্যের পাশাপাশি মঙ্গলচন্ডী পালা গান হয়। বিজয়া দশমীর দিন স্থানীয় এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনরা মন্ডপ থেকে মাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে আত্রেয়ী নদীতে বিসর্জন দেয়। পূর্বে আত্রেয়ী নদীতে বিসর্জনের আগে মাকে নৌকোতে সাত পাক ঘোরানো হতো। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে বিসর্জনের আগে এই নৌকায় ঘোরানোর প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। মন্ডপ থেকে বিসর্জনের পথে নিয়ে যাওয়ার সময় বালুরঘাট শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাটে ভক্তরা দাঁড়িয়ে থেকে পান, সুপারি, ধান, দুর্বা ও বাতাসা দিয়ে মাকে বরণ করে।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

About The Author


Enable Notifications OK No thanks
Verified by MonsterInsights