বহরমপুর জেলেই সরস্বতী পুজো করেছিলেন নেতাজি, বন্দিদশার শতবর্ষে সেল সংরক্ষণের দাবি


রাজেন্দ্র নাথ দত্ত:মুর্শিদাবাদ: গোটা দেশ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে উত্তাল, তখন বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দি ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেলের অন্দরে ছিল সুভাষের আলাদা কদর। আজ বহরমপুরে যেটা মানসিক হাসপাতাল, সেটা ছিল তৎকালীন বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল। এই জেলেই তিনি আয়োজন করেছিলেন সরস্বতী পুজোর। দুর্গাপুজোর মতো এলাহি আয়োজন ছিল। পুজোয় হাত মিলিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম বন্দিরাও। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। এই সংশোধনাগারে কাজি নজরুল ইসলামও বন্দি ছিলেন। কিন্তু আক্ষেপের ঘটনা হল, সংগ্রামে ও সাহিত্যে দুই মহারথীর কারাগার কক্ষ দু’টি অনাদরে পড়ে। তাঁদের জেলবন্দির ইতিহাসকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার গরজ নেই কোনওপক্ষের। তাই প্রতিবারের মতো এবার নেতাজির জন্মদিনের আগেই কারাগার কক্ষ দু’টি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। সেগুলি সংস্কার করে নেতাজি ও নজরুলের সংগ্রহশালা বা নেতাজি-নজরুল চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারে সরব হয়েছেন বহরমপুরবাসী।

ইতিহাস বলছে, সুভাষচন্দ্র বসুকে ১৯২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বহরমপুর জেলে আনা হয়। ১৯২৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। ওই সময়ের মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল সরস্বতী পুজো। নেতাজি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জেলে বসেই বাগ্‌঩দেবীর আরাধনা করবেন। সেই মতো ধুমধামের সঙ্গে আয়োজন শুরু করে দেন সুভাষচন্দ্র। সেই পুজো দেখতে গোটা জেলা থেকে হাজির হয়েছিলেন প্রচুর মানুষ। পুজো দেখার অছিলায় বিপ্লবীরা জেলে এসে দেখা করে ছিলেন প্রিয় নেতার সঙ্গে। সেই হিসেবে এ বছর নেতাজির বহরমপুরে জেলবন্দির শতবর্ষ। তাই তাঁর নামে সংগ্রহশালা গড়ার দাবি আরও বেশি জোরালো হয়েছে এবার।
ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, বন্দি সুভাষ চন্দ্র বসু ওই সময় দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে পড়ার বই পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখেন। রাজবন্দিদের জন্য বই কেনা সহ নানান দাবিতে তিনি বন্দিদশায় আন্দোলনও করেছিলেন। জেলেই তিনি শুরু করেছিলেন টেনিস খেলা ও শরীর চর্চা। প্রথম সংশোধনাগারের মধ্যেই তিনি সরস্বতী পুজো করেছিলেন। বর্তমানে সেই সংশোধনাগারের জীর্ণদশা। বর্তমানে সেটি মানসিক হাসপাতাল।
শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র’ বই থেকে জানা যায়, জেলের মধ্যে সরস্বতী পুজো করার ব্যাপারে একেবারেই নাছোড় ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। প্রথমে উজর-আপত্তি করেছিল জেল কর্তৃপক্ষ। পরে সুভাষচন্দ্রের দৃঢ়তা কাছে নতি স্বীকার করে সরস্বতীপুজোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এবং পুজোর ব্যবস্থাও করে দেয়। শোনা যায়, সেই সরস্বতী পুজো দেখার ভিড় যা হয়েছিল, তা সে সময়ের দুর্গাপুজোর ভিড়ের সমান। আসলে ভিড়ের মধ্যে সিংহভাগই ছিলেন বিপ্লবীরা।

বহরমপুরের ইতিহাসবিদ রমাপ্রসাদ ভাস্কর বলেন, ‘সুভাষচন্দ্র বসু বহরমপুর জেলে যতদিন ছিলেন, তিনি এখানেই নেতাজির মত বিরাজ করতেন। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যান্য জেলবন্দির জন্য বই পড়া এবং শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। প্রচুর বই পত্র আনিয়ে লাগাতার পড়তেন। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমাজব্যবস্থা নিয়েও পড়াশোনা করতেন। যে সেলে বন্দি ছিলেন সেটা এখন মানসিক হাসপাতালের ভিতরেই রয়েছে। সেই সেলগুলি সংরক্ষণ করা গেলে বর্তমান প্রজন্ম নেতাজি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।’


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights