প্রবাদ প্রতীম ছৌশিল্পী ধুঁন্দা মাহাতোর প্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি । “ছৌশিল্পী ধুঁন্দা মাহাতোর ছৌ নৃত্য সাধনা।” —


প্রবাদ প্রতীম ছৌশিল্পী ধুঁন্দা মাহাতোর প্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি । 
“ছৌশিল্পী ধুঁন্দা মাহাতোর ছৌ নৃত্য সাধনা।” —
ড. দয়াময় রায়।
ভূমিকা:-
পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র সাত কি:মি: পশ্চিমে কাঁসাই নদীর ঠিক উত্তর দিকে বালিগাড়া গ্রাম। ভাটবাঁধ মোড় থেকে পিচ ঢালা রাস্তার বাঁক ধরে ধরে  বাঁয়ে ডাইনে করতে করতে পৌছানো যায় বালিগাড়া গ্রামে। ছৌনাচ, ধুঁন্দা মাহাতো ( আসল নাম ধনঞ্জয় মাহাতো) আর বালিগাড়া এক সমার্থক নাম। লোকনাচের অর্থাৎ ছৌনাচের জগতে তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত লোক শিল্পী। কেননা ছৌনাচ বীরত্বব্যঞ্জক আর তার বিপরীতে যে করুণ রস তার একচ্ছত্র আধিপত্য ধুঁন্দা মাহাতোর নাচে। বিশেষত কিরাত অর্জুন নাচে যে বীর ও করুণ রসের সঞ্চার হয় সে বিষয়ে চোখের জল এনে নৃত্য নাট্যের সমাপণ ঘটিয়েছেন তিনি। বরং বলা যায়  এ নাচের ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার তিনি স্রষ্টা।
বাল্যকাল:-
ধুঁন্দা মাহাতোর শৈশব কেটেছে ছৌনাচের আবহে। তাঁর বাবা স্বর্গীয় পেলারাম মাহাতো ছৌনাচের শিল্পী।  তিনিও এ নৃত্য ঘরানাকে বাঁচাতে এবং সেই শৈলী দ্বারা লালন পালন করেছেন নিজের পরিবারকে। ধনঞ্জয় মাহাতোরা তিন ভাই সকলেই ছৌনাচের তালিম নিয়েছেন বাবার কাছ থেকে। ধুঁন্দা সব চেয়ে বড়ো ভাই রূপে তাঁর দায়দায়িত্ব বেশি। এমন কি তাঁর বাবা ছৌওস্তাদ এনে ছৌনাচের রীতিমতো ট্রেনিং করান। লাগদা হাইস্কুল থেকে পড়াশুনা করেন ধনঞ্জয় বাবু   কিন্তু নানা অসুবিধা হওয়ার ফলে বেশিদিন লেখাপড়া  চালাতে পারেন নি। এরপর  পুরোপুরি ভাবে ছৌনাচে মগ্ন হয়ে পড়েন। 
শিল্পী সত্ত্বার সূচনালগ্ন:- 
তাঁর পিতার সেটাই ছিল ইচ্ছে যে তাঁর ছেলে একজন বড়ো শিল্পী হোক। কিন্তু আসরে প্রদর্শন করতে না পারলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি না হলে শিল্পী সত্ত্বার বিকাশ ঘটবে কি করে?  এই চিন্তায় তাঁর বাবা পার্শ্ববর্তী সোনাই জুড়ি গ্রামের গাজন পরবে নিজের ছেলের ছৌনাচ দেখানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।  কোন ভাবেই জরু কুমারের মতো একজন প্রথিতযশা শিল্পীর সাথে মেলা কর্তৃপক্ষ কিশোর শিল্পী ধনঞ্জয় মাহাতোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামাতে দিতে রাজি হয় নি। কিন্তু শিল্পীর বাবাও নাছোড়বান্দা, এমনকি আজ থেকে ষাট পয়ষট্টি বছর আগে নগদে  পাঁচশ’ টাকা কমিটিকে দিয়ে ছেলেকে ছৌনাচের শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতায় নামান। চারদিকে ঢিঢি পড়ে যায় তেরো চৌদ্দ বছরের এক বালকের অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু অসম এই প্রতিযোগিতায় এক তাল নাচের পরই পেট ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন।  কিন্তু বাবার জেদ আর শপথের কাছে হার মানবে কে? চূড়ান্ত ভাবেই সেই নাচের আসরে বীরবিক্রমে সুপ্রতিষ্ঠিত হন ধনঞ্জয় মাহাতো।
এ যেন এবার –‘ ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটি গেল গ্রামে গ্রামে।’ 
আর পিছন ফিরে তাকানো নয়, এবার এগিয়ে চলা।  এরপরে সেকালের বিহারের খুঁটি এবং মুরি এলাকায় নৃত্য প্রদর্শন করে তিনি প্রচুর সুনাম কুড়ান। প্রতিবছর সেখান থেকে ডাক পেতে থাকেন এভাবেই ধুঁন্দা মাহাতোর ছৌবিজয় রথ এগিয়ে চলতে থাকে। সারা মানভূম জেলা ছাড়িয়ে রাঁচি প্রভৃতি এলাকায় ‘ধনঞ্জয় মাহাতো কৃষি মঙ্গল ছৌনৃত্য দল ‘- এর প্রসার ঘটে।  
ছৌশিল্পের প্রতি আনুগত্য :- 
ধুঁন্দা মাহাতো সাবেকি এই নাচের শৈলীর প্রতি অনুরক্ত।  ধামসা, সানাই, মেরাকশ, চেড়পেটি সহ  প্রাচীন বাদ্য, সুর, তাল, লয় নিয়ে প্রচলিত ঘরানা নির্ভর পরম্পরায় তিনি বিশ্বাসী।  সময় ও যুগের দাবী মেনে না নিলেও মুশকিল, কেননা প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে হলে ক্যাসিও নির্ভরতা প্রয়োজন । বাহ্যিক নাটকীয়তা ছৌ নাচের ধারাটিকে নষ্ট করে তুললেও উপায় নেই বলেই তাঁরও অভিমত। কিন্তু ছৌনাচের প্রবাহে যে রীরত্ব, রৌদ্ররস তা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না।
ছৌভাবনা:– 
শিল্পী ধুঁন্দা মাহাতোর মতে, ছৌনাচ আসলে ছয়টি অংগের সঞ্চালন, ছ’ টি অংগ হল -১) মুখ, ২) বুক, ৩) দু’হাত আর ৪) দু’ পা। এই ছ’টি অঙ্গের আন্দোলন সঠিকভাবে না করতে পারলে ছৌনাচের রীর ধর্ম রক্ষিত হতে পারে না। তাঁর মতে মুখের ভাব, অভিব্যক্তি মুখোশের আড়ালে রেখে ছয় অঙ্গের সাহায্যে প্রতীকি ব্যবহারের মধ্যেই ছৌনাচের অনুভূতি, গতি, সুখ- দু:খের প্রকাশ। 
ছৌওস্তাদ কালীপদ মাহাতো যাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন–‘ছ’ লাচ হ’ল তাই যে লাচের মাধ্যমে ষড় রিপুদমন করা যায়।’ তবে মাথা বুক পা যদি টান টান করে না রাখা যায় তাহলে রীররস মার খাবেই, এ ব্যাপারে ধনঞ্জয় মাহাতো একমত। 
আশি বছর বয়সের দ্বারপ্রান্তে পৌছেও তিনি এক যুবক।  তেরো চৌদ্দ বছর বয়স থেকে প্রায় সত্তর বছর বয়স অবধি অর্থাৎ অর্ধ শতাব্দী সময় জুড়ে (১৯৬০– ২০১০) ছৌনাচকেই শিল্পসাধনার মূল মন্ত্র করে আজো ছেলে দেবেন মাহাতো তথা দলের  প্রধান স্থপতি রূপে কাজ করে চলেছেন। বিশ্বে ছৌনাচকে যিনি পৌছে দিয়েছিলেন সেই গম্ভীর সিংমুড়া, তাঁর কথা বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন।
পুরষ্কার- সম্মাননা:-  
ছৌনাচের আসর মাতাতে তিনি পশ্চিম বঙ্গ ছাড়া ভারতের কম বেশি বেশির ভাগ রাজ্যে এ নাচকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু দু:খের বিষয় এখনো তেমন কোনো সরকারি পুরষ্কার বা সম্মাননা পান নি। একবার কেন্দ্রীয় সংগীত নৃত্য নাটক একাদেমিতে নাম উঠলেও শেষ অবধি  পুরষ্কার পান নি। পুরুলিয়া জেলার বেশ কয়েকটি সংস্থা তাঁকে বিভিন্ন সময় সম্মাননা জ্ঞাপন করে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল–১) আদিবাসী লোক সংস্কৃতি বিকাশ পরিষদ, ২) বিবেক বাহিনী ব্রতচারী সখা, ৩) ওয়েস্ট বেঙ্গল ভেটিনারি এসোসিয়েশন, ৪) মানভূম দলিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি একাদেমী প্রভৃতি। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পী ভাতা প্রাপক।
কিন্তু ধুঁন্দা মাহাতোর মতো জেলার ছৌনাচ বা লোক নাচের প্রথিতনামা শিল্পীদের ‘ পদ্মশ্রী গম্ভীর সিংমুড়া ‘ নামাঙ্কিত সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। কেননা লোকগানের জগতে লালন পুরষ্কার চালু আছে, সেকারণেই ‘পদ্মশ্রী গম্ভীর সিংমুড়া’ পুরষ্কার লোকনাচের ক্ষেত্রে চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন করছি। সরকার এবিষয়ে পদক্ষেপ নিলে বীররসাত্মক  নৃত্য শিল্পীরা আলো দেখবে এবং আরো এগিয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস করি।
তথ্যচিত্র :– নিবেদিতা মজুমদার স্বল্প দৈর্ঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চিত্র ধুঁন্দা মাহাতোকে নিয়ে নির্মাণ করেন। যার নাম ‘ ধ্রুপদী ধুঁন্দা ‘।
© সাক্ষাতকার – ১২/০৮/২০১৮।

About The Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights